শনিবার, ফেব্রুয়ারী ০৯, ২০১৯

ইসলামের জন্য জীবন, নাকি জীবনের জন্য ইসলাম?

সর্বশেষ উমাইয়া খলিফা মারওয়ান ইবনে মুহাম্মদের সময় ইরাকের গভর্নর ছিলেন ইয়াজিদ ইবনে আমর। তিনি আবু হানিফা রহ.কে ইরাকের গভর্নরের দায়িত্ব গ্রহণ করতে বললে আবু হানিফা রহ. অস্বীকৃতি জানান। সে সময় রাষ্ট্রের অবস্থা ছিল ভঙ্গুর।
বিদ্রোহ দমনের জন্য যে নানাবিধ দমননীতি গ্রহণ করা হয়েছিল- আশঙ্কা ছিল এক্ষেত্রে বিচারব্যবস্থার যথেচ্ছ ব্যবহার করা হবে এবং যাবতীয় অবিচারের সামাজিক বৈধতা জাহির করতে রাষ্ট্র আবু হানিফার ভাবমূর্তী ও গ্রহণযোগ্যতাকে ব্যবহার করবে।
আবু হানিফা রহ. তাই এ নিয়োগের ব্যাপারে ঘোরতোর আপত্তি জানান। ইয়াজিদ ইবনে আমর এতে ক্ষুব্ধ হয়ে একশদশটি চাবুকাঘাতের নির্দেশ দেন আবু হানিফার মাথা ও ঘাড়ে। পরদিন আবু হানিফা রহ. পরামর্শ করার সময় চেয়ে কৌশলে হিজাযে হিজরত করেন।
মক্কা ও মদীনায় বছর পাঁচেক অবস্থানকালে ১৩২ (৭৫০ ঈসাব্দ) হিজরিতে উমাইয়া খেলাফতের পতনের পর আব্বাসী খেলাফত আমলে তিনি স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। আব্বাসীদের আমলে আবু হানিফা রহ. সম্মানিত ও মান্য বলে শাসকশ্রেণীর কাছে গণ্য হতেন।
এমনকি ২য় আব্বাসী খলিফা আবু জাফর আল মানসুর, যিনি আবু হানিফার কারাহত্যা সংঘটিত করেন তিনিও দায়িত্ব গ্রহণের পর আবু হানিফার কাছে হাদিয়া স্বরূপ ১০ হাজার দিরহাম ও একজন দাসী প্রেরণ করেছিলেন। অবশ্য আবু হানিফা রহ. তাঁর স্বভাবসিদ্ধ রীতি অনুযায়ী তা ফেরত পাঠান।
মানসুরের বিরুদ্ধে মদিনায় মোহাম্মদ রহ. বিদ্রোহ করেন। তাঁর ভাই, ইব্রাহিম ছিলেন এই ব্যাপারে তাঁর রাজনৈতিক দূত। (এই ভাতৃদ্বয় হাসান রা. এঁর নাতি। তাঁরাসহ তাঁদের পরিবারের কমপক্ষে ১০ জন খলিফা মনসুরের হাতে শহীদ হন।) তিনি ১৪৫ হিজরিতে কুফা সফর করেন। কুফা সফরকালে তিনি আবু হানিফা রহ. এঁর সাথে সাক্ষাত করেন।
স্বাভাবিকভাবেই নবী পরিবারের সদস্য হওয়ায় আবু হানিফা রহ. তাঁকে উষ্ণ আতিথেয়তা প্রদর্শন করেন। গুজব রটে যে, আবু হানিফা রহ. এই বিদ্রোহের স্বপক্ষে মত দিয়েছেন ও সাহায্য করেছেন। মানসুর বহুসংখ্যক হত্যার মধ্য দিয়ে এই বিদ্রোহ দমন করেন। খলিফা মনসুর আবু হানিফা রহ. কে কুফা থেকে বাগদাদে নিয়ে আসেন।
মানসুরের বিরুদ্ধে ছোট ছোট ও খণ্ড খণ্ড আরও বিদ্রোহ অব্যাহত থাকায় তার আশঙ্কা ছিল যে, সামান্যতম সুযোগ পেলেপ যেকোনও বিদ্রোহ সংগঠিত হয়ে তাঁর শাসনকালের সমাপ্তি এনে দিতে পারে।
এজন্য তার শাসনকে আরও নিঃশঙ্ক করতে আবু হানিফাকে অনুরোধ করেন যেন তিনি এই ফতওয়া প্রদান করেন যে, খলিফা মানসুর ‘আলা মিনহাজিন নবুওয়্যাহ’ অর্থাৎ নবুওইয়্যাতের পথ ও পদ্ধতির উপর প্রতিষ্ঠিত এবং তিনি পরিপূর্ণ হক্ব।
এর মানে এই দাঁড়ায় যে, তার বিরুদ্ধে যাবতীয় বিদ্রোহ হারাম। আর বিদ্রোহীরা সর্বোচ্চ শরয়ী ফৌজদারি দণ্ড আরোপযোগ্য। যা ছিল প্রকারান্তরে খলিফা মানসুরের যাবতীয় জুলুমকে একবাক্যে বৈধ বলে ফতোয়া দেওয়ার নামান্তর।
বিনিময়ে মানসুর আবু হানিফাকে কাযী-উল-কুযাত (চিফ জাস্টিস, সুপ্রিম কোর্ট অব আপিল) পদ গ্রহণের প্রস্তাব করেন। আবু হানীফা রহ. দৃঢ়ভাবে তা প্রত্যাখান করেন। মানসুর তাঁর পায়ে ত্রিশটা বেত্রঘাত করে, তাঁর পা ফেটে রক্ত ঝরতে শুরু করে এবং তাঁকে কারান্তরীণ করার নির্দেশ দেন।
পুনরায় তাঁকে ডেকে এনে ক্ষমা চান এবং তাঁর সামনে হাদিয়াস্বরূপ ৩০ হাজার দিরহাম উপস্থাপন করেন। এবারেও আবু হানিফা রহ. মানসুরের যাবতীয় প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।
ঐতিহাসিক কিছু নির্ভরযোগ্য বর্ণনামতে, এবার মনসুর এই নির্দেশ প্রদান করেন যে, তার মতে সম্মত না হওয়া পর্যন্ত প্রত্যেক পরবর্তী দিন ১০ বেত্রাঘাত করে বাড়িয়ে আবু হানিফাকে বেত্রাঘাত করা হবে।
একাদশতম দিনে অর্থাৎ ১১০ বেত্রাঘাত প্রদানের দিন তাঁকে বিষমিশ্রিত শরবত পান করানো হয়। সেজদারত অবস্থায় আবু হানীফা রহ. শাহাদাত বরণ করেন। সেলজুকদের আমলে তাঁর কবরের উপর গম্বুজ নির্মাণ করে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
আমাদের পূর্ব-পুরুষ, ইমামে আজম আবু হানীফা সেদিন রাজকীয় নেয়ামতকে উপেক্ষা করে বিপরীতে এই ভয়াবহ অব্যাহত জুলুমকে মেনে নিয়ে শেষাবধি শাহাদাতকে মেনে নিয়েছেন কিন্তু কোনও অন্যায়ের, জুলুমের সঙ্গী হন নি। হক্বকে পরিত্যাগ করেন নি।
ইসলামী ইতিহাসের জগতের আরেক নক্ষত্র কাযী ইয়ায রহ.। যিনি ছিলেন মুরাবিতুন সালতানাতের সময়ে সাবতার কাযী, ইমাম। নগরটি Ceuta নামে আধুনিক স্পেনের দখলীকৃত। স্পেনে শহরটি স্বায়ত্ত্বশাসন ভোগ করে থাকে।
আফ্রিকান এই দ্বীপ আদতে ঐতিহাসিকভাবে মরোক্কোর অবিচ্ছেদ্য একটি শহর। ছিলেন স্পেনের গ্রানাডা কেন্দ্রীক ইমারাত-আল-গ্রানাথা (গ্রানাডা)র প্রধান বিচারপতি।
মুরাবিতুন সালতানাত গঠিত হয়েছিল মরক্কো, আলজেরিয়া, মৌরিতানিয়া, ক্যামেরুন, নাইজেরিয়া থেকে সেনেগাল নদীর সীমা অবধি বিস্তার নিয়ে, উলামা ও হক্বপন্থীদের নেতৃত্বে। ক্রমে যখন সেইসব গৌরব হারিয়ে যাচ্ছিল তখন নিজেদের কাজের ফল হিসেবেই আল মোয়াহহিদিন সালাতানাতের হাতে পতন হয় মুরাবিতুনিদের।
মোয়াহহিদিন সালাতানের প্রতিষ্ঠাতা ইবনে তুমারত ছিলেন ভয়াবহ জালিম। তিনি নজিরবিহীন হত্যাযজ্ঞ সংগঠিত করেছেন। এই সম্রাজ্য সে যুগেই প্রায় ১০ লাখ মানুষের হত্যাকাণ্ড সংগঠিত করেছিল। তিনি আকীদাগতভাবে ভ্রান্ত ছিলেন।
এই মোয়াহহিদিনরা সাবতাও দখলে নেয়। কাযী ইয়াযকে স্বপদে বহাল রাখা হয়। ম্যায়ুরকা (Mallorca, Spain) দ্বীপের শাসকের প্রতিশ্রুতিতে সাবতাবাসী মোয়াহহিদিনদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। মোয়াহহিদিনরা সাবতার দিকে মার্চ করে।
কিন্তু ম্যায়ুরকার শাসক শেষাবধি সাবতাবাসীদের প্রতি প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করায় শহরকে বাঁচাতে কাযী ইয়াজ নিজেকে মোয়াহহিদিনদের নিকট সমর্পণ করেন। বিদ্রোহের যাবতীয় দায় নিজের একক দায় হিসেবে স্বীকার করেন। মোয়াহহিদিনরা শহরবাসীর জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে।
কাযী ইয়াজকেও ক্ষমার প্রতিশ্রুতি দেয় এবং বিচারপতির পদবহালের নিশ্চয়তা দেয় এই শর্তে যে- ১। এই সালতানাতের প্রতিষ্ঠাতা ইবনে তুরমাত (Ibn Turmat)কে নিষ্পাপ ঘোষণা করতে হবে। ২। ইবনে তুরমাতকে ইমাম মাহদি হিসেবে মেনে ফতোয়া দিতে হবে।
সেই ফতোয়া পুস্তকাকারে সালতানাতের সমস্ত প্রান্তে প্রচার করা হবে। কাযী ইয়ায এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি স্পষ্ট বলেন, যে দাজ্জাল সে কী করে মাহদি হতে পারে? মোয়াহহিদিনদের জুলুমের তরবারি তাঁর উপর নেমে আসে।
তাঁকে টুকরো টুকরো করে কাটা হয়। বর্শা দিয়ে একটু একটু করে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে করে তাঁকে শহীদ করা হয়। লাশকে একেবারে ছোট ছোট টুকরো টুকরো করে কেটে জানাজা বিহীন পুঁতে রাখা হয় মারাক্কেশের এক প্রান্তে।
মারাক্কেশ মরোক্কোর পশ্চিমাঞ্চলের প্রধান শহর ও দেশটির চতুর্থ বৃহৎ নগরী। তাঁর দাফনের জায়গা খ্রিস্টানদের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়, নির্মাণ করা হয় গীর্জা। মুয়াহহিদিনদেরও পতন হয় মারিনিয়্যুন (Marinid) সালাতানাতের হাতে। সে সময় তাঁর কবরকেও উদ্ধার করা হয়।
যে ইলম তাঁদের করেছিল হক্বের প্রতি এতটা দৃঢ়, সে ইলমের উত্তরাধিকারী দাবি করেও আমরা কেন এতটা ভঙ্গুর? যে ঈমান তাঁদের করেছিল এত অবিচল সে ঈমানের উত্তরসূরী হওয়া স্বত্ত্বেও আমরা কেনইবা এত বিচলিত, এত ভীত?
কার্টেসিঃ আরজু আহমাদ

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সম্পর্ক ভাঙ্গার ১০১ উপায়

মানিব্যাগটা হাতে নিতেই বুঝতে পারলাম এখান থেকে বেশ কিছু টাকা হাত সাফাই হয়েছে। গুনে দেখি দুইশো টাকা মতো গায়েব। আমার মানিব্যাগ থেকে টাকা গায়েব...