সোমবার, জানুয়ারী ২৫, ২০১৬

ইবনে সিনা

যিনি  কঠোর জ্ঞান সাধনা ও অধ্যবসয়ের মধ্যে দিয়ে কাটিয়ে ছিলেন সারাটা জীবন , এক রাজপরিবারে জন্মগ্রহণ করেও ধন-সম্পদ, ক্ষমতা, ভোগ-বিলাস ও প্রাচুর্যের মোহ যাকে আকৃষ্ট করতে পারেনি , যিনি ছিলেন মুসলমানদের গৌরব ... তিনি হলেন ইবনে সিনা । তাঁর আসল নাম আবু আলী আল হুসাইন ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে সিনা । তিনি সাধারনত ইবনে সিনা , বু-আলী সিনা এবং আবু আলী সিনা নামেই অধিক পরিচিত । 

Image result for ibn sina
Ibn Sina


    ৯৮০ খৃষ্টাব্দে তুর্কীস্তানের বিখ্যাত শহর বোখরার নিকটবর্তী আফসানা গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর পিতা আব্দুল্লাহ এবং মাতা সিতারা বিবি । পিতা আব্দুল্লাহ ছিলেন খোরসানের শাসনকর্তা । জন্মের কিছু কাল পরই তিনি ইবনে সিনাকে রোখারায় নিয়ে আসেন এবং তাঁর লেখাপড়ার সু-ব্যাবস্থা করেন । ছোট বেলা থেকেই তাঁর মধ্যে লুকিয়ে ছিলো অসামান্য মেধা ও প্রতিভা । মাত্র ১০ বছর বয়সেই তিনি পবিত্র কোরআনের ৩০ পারা মুখস্থ করে ফেলেন । তাঁর ৩ জন গৃহ শিক্ষক ছিলো । তাদের মধ্যে ইসমাইল সূফী তাঁকে শিক্ষা দিতেন ধর্মতত্ত্ব , ফিকাহ শাস্ত্র ও তাফসীর । মাহমুদ মাসসাহ তাঁকে শিক্ষা দিতেন গণিত শাস্ত্র এবং বিখ্যাত দার্শনিক আল না’তেলী শিক্ষা দিতেন দর্শন , ন্যায় শাস্ত্র , জ্যামিতি , টলেমির আল মাজেস্ট , জাওয়াহেরে মান্তেক প্রভৃতি । মাত্র ১৭ বছর বয়সে সকল জ্ঞান তিনি লাভ করে ফেলেন । বিখ্যাত দার্শনিক আল না’তেলীর নিকট এমন কোন জ্ঞান আর অবশিষ্ট ছিল না , যা তিনি ইবনে সিনাকে শিক্ষা দিতে পারবেন । এরপর তিনি ইবনে সিনাকে নিজের স্বাধীন মত গবেষ্ণা করার পরামর্শ দেন । 


এবার তিনি চিকিৎসা বিদ্যা সম্পর্কিত কিতাব সংগ্রহ করে গবেষণা করতে শুরু করেন । ইবনে সিনা তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন যে , এমন বহু দিবা রাত্রি অতিবাহিত হয়েছে যার মধ্যে তিনি ক্ষনিকের জন্যও ঘুমাননি । কেবলমাত্র জ্ঞান সাধনার মধ্যেই ছিল তাঁর মনোনিবেশ । যদি কখনো কোন বিষয়ে সমস্যার সম্মুখীন হতেন তখনই তিনি মসজিদে গিয়ে নফল নামায আদায় করতেন এবং সেজদায় পড়ে আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করে বলতেন , “ হে আল্লাহ , তুমি আমার জ্ঞানের দরজা খুলে দাও । জ্ঞান লাভ ছাড়া পৃথিবীতে আমার আর কোন কামনা নেই ।” তারপর গৃহে এসে আবার গবেষণা শুরু করতেন । ক্লান্তিতে যখন ঘুমিয়ে পড়তেন তখন অমীমাংসিত প্রশ্নগুলো  স্বপ্নের ন্যায় তাঁর মনের মধ্যে ভাসতো এবং তাঁর জ্ঞানের দরজা যেন খুলে যেত । হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে উঠেই সমস্যাগুলোর সমাধান পেয়ে যেতেন । মাত্র ১৮ বছর বয়সে তিনি চিকিৎসা বিদ্যায় ইন্দ্রজালের সৃষ্টি করেন এবং চতুর্দিকে তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে । এ সময় বোখারার বাদশাহ নূহ-ব ইন-মনসুর এক কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন । দেশের বিখ্যাত চিকিতসকগণ তাঁকে সুস্থ করে তুলতে যখন ব্যারথ হন তখন ইবনে সিনা মাত্র কয়েকদিন চিকিতসা করে বাদশাহকে সুস্থ করে তোলেন । বাদশাহ কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তাঁর জন্য রাজ দরবারের কুতুবখানার সব কিতাব মুখস্থ করে ফেলেন । জ্ঞান বিজ্ঞানের এমন কোন বিষয় বাকি ছিল না যা তিনি জানেন না । মাত্র ১৯ বছর বয়সে তিনি বিজ্ঞান , দর্শন , ইতিহাস , অর্থনীতি , রাজনীতি , কণিতশাস্ত্র , জ্যামিতি , ন্যায়শাস্ত্র , খোদাতত্ত্ব , চিকিতসা শাস্ত্র , কাব্য , সাহিত্য প্রভৃতি বিষ্যে অসীম জ্ঞানের অধিকারী হন । ২১ বছর বয়সে 'আল মজমুয়া' নামক একটি বিশ্বকোষ রচনা করেন , যার মধ্যে গণিত শাস্ত্র ব্যতীত প্রায় সকল বিষ্যায়াদি লিপিবদ্ধ করেছিলেন ।

বুধবার, জানুয়ারী ২০, ২০১৬

রুটিন মাফিক চলার ৩টি সহজ উপায় যা আপনার শরীরের সুস্থতা ও সক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করবে

কিছু ব্যাপার আমাদের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ , কিছু ব্যাপার অত্যাবশ্যক । আমাদের বুঝতে হবে কোনটা কাজটা আমাদের আগে করা উচিত কোন কাজটি পরে ।তাই এই লেখাটি আশা করি আপনাদের সাহায্য করবে । 


১। সকল অর্ধসমাপ্ত কাজের সমাপ্তি করা যে কোন ভাবেই হোক


বর্তমান সময়ে দেখা যায় যে আমরা সহযেই একটি কাজের উপর থেকে মনযোগ হারিয়ে ফেলি । সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো এর মধ্যে অন্যতম যারা আমাদের দৈনন্দিন কাজের উপর প্রভাব ফেলে । আসলে আমরা চাই যে সব গুলো চিঠি , ইমেইল এবং দৈনন্দিন কাজের তালিকার কাজ একসাথেই করতে । কিন্তু এসব যোগাযোগ মাধম্যের কারনে হাতের একটা কাজ শেষ করে আরেকটা কাজ শুরু করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায় । কিভাবে ? ধরুন …
  • আপনি একটি রিপোর্ট লেখা শুরু করেছিলেন । কিন্তু এর ফাকে ফাকে ফেসবুক , ইউটিউবে আপডেট চেক করতে করতেই আপনার লেখাটা আর শেষ হলো না । অথচ আপডেট চেক করার চেয়ে কিন্তু রিপোর্টটি তৈরী করা গুরুত্বপূর্ণ ছিলো ।
  • আপনি একটি দৈনন্দিন খাবারের তালিকা তৈরী করলেন । কিন্তু দু’দিন বাদেই কোথাও পড়লেন যে ঐ ভাবে খাওয়া দেওয়া করলে তাড়াতাড়ি ওজন কমিয়ে একই রকম স্বাস্থ্য ধরে রাখা সম্ভব । আপনি তাই আগের তালিকা বাদ দিয়ে নতুন ভাবে শুরু করলেন । কিছুদিন বাদেই দেখলেন যে এটা ভালই কাজ করছে ! তাই আবার খোজা শুরু করলেন আরো ভালো কি পাওয়া যায় ।
  • দেখা যায় কারো সাথে কথা বলছিলেন , এরই মাঝে একটা মেইল আসলো । আপনি কথা বলা থামিয়ে মেইল দেখায় মগ্ন হয়ে গেলেন ।

এইভাবেই দেখা যায় আমাদের অনেক অর্ধ সমাপ্ত কাজ থেকেই যায় । একটা সময় দেখা যায় এই অর্ধ সমাপ্ত কাজ গুলোই যতটা না সময় লাগার কথা তার চেয়ে বেশি সময় লেগে যায় । ফলাফল হিসেবে  দেখা যায় যে ছুটির আগে আপনাকে এই কাজগুলোই তাড়াহুড়োর মধ্যে করে ফেলতে হচ্ছে । ফলে কাজগুলো সুন্দর করে সম্পন্ন করেতে পারছেন না । অনেক গুরুত্বপূর্ন ব্যাপারও হয়তো খেয়ালও করতে পারেননি । এর জন্য পরবর্তিতে ভুগতে হতে হয় ।


শুধু মাত্র একটি কাজের উপরই একই সময় মনোযোগ দিন ।


এই জন্য প্রথমেই দিনের একটা অংশ গুরুত্বপূর্ন কাজ গুলোর জন্য আলাদা করে ফেলুন । ঐ সময় যেখানে কাজ করবেন , তার আশেপাশেও ফোন রাখবেন না এবং ফেসবুক , মেইল ইত্যাদি একদম বন্ধ করে রাখুন যেন এগুলো জ্বালাতন করতে না পারে ।

এসব যোগাযোগ মাধ্যম গুলো আপনার কাজে সবসময়ই ব্যাঘাত সৃষ্টি করে থাকে । তবে কাজ শেষে অবশ্যই ফোন ও অন্যান্য যোগাযোগ মাধ্যম গুলো ঘুরে আসবেন । কারন অনেক গুরুত্বপূর্ন কাজ এর মধ্যমেও এসে পড়তে পারে । এভাবেই এসব থেকে কিছুটা সময় দূরে থেকে আপনি সহজেই আপনার অর্ধ-সমাপ্ত কাজটি সমাধা করতে পারেন ।



২। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি আগে করুন ।



দ্বিধা দ্বন্ধ লেগেই থাকবে জীবনে । এবং তা আপনার সময়ও প্রচুর অপচয় করাবে । আপনার ইচ্ছা শক্তিকে দমিয়ে রাখে এই দ্বিধা দ্বন্ধ । তাই দিনের শুরুতেই আপনাকে প্রথমেই একটি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে ।
সত্যি বলতে কি , আমার কাজের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে আমি সহজেই দমে যাই , আমার ইচ্ছে শক্তি অনেক কম এবং সহজেই ভেঙ্গে পড়ি । তাই কোন কাজটা সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ তা বের করার চেষ্টা শুরু করলাম এবং মনে প্রানে তা করা শুরু করলাম । যদি দেখতাম যে আমার একটা প্রতিবেদন লিখতে হবে আজই , তখন আমি সকালে যত তাড়াতাড়ি পারি এক গ্লাস পানি খেয়েই লেখা শুরু করে দিতাম । তাই , যদি কোন কঠিন কাজ থাকে তা অবশ্যই শুরুতেই শেষ করে দিন । সারাটা দিন নিজেকে অনেক হালকা লাগবে ।
কিন্তু যদি গুরুত্বপূর্ণ কাজটি প্রথমেই না করে অন্য কোন সময়ের জন্য রেখে দেন , তবে দেখা যাবে ঐ দিনটা ঐ কাজের চিন্তাতেই নষ্ট হচ্ছে । তাই যত দ্রুত সম্ভব দিনের শুরুতেই গুরুত্বপূর্ণ কাজের সমাপ্তি করুন , যদি দিনটার কোন পরিকল্পনা না ও থাকে এবং দিন শেষে একটি প্রশান্তিময় ঘুম পরের দিনের জন্য আপনাকে তৈরী করে দিবে ।


৩। সময়মাফিক চলতে হবে , লক্ষ্য সীমিত করে হলেও


সময়মাফিক চলাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ । তাই নিজেকে সময়ের সাথে খাপ খাইয়ে রাখতে হবে , লক্ষ্যের সাথে না । গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো সময়মাফিক করলেই বেশি ভালো হয় । যদি এমন হয় “আজকেই শেষ সময় “ তবে তা ভিন্ন কথা ।
যখন আপনি এভাবে দিনের পর দিন একই ভাবে সময়মাফিক কাজ করে যাবেন , দেখবেন চাপ অনেকটাই কম থাকবে । সময়মেনে কাজ করাটা সত্যিকার অর্থেই একেবারে একটা কাজ করে ফেলার চেয়ে সহজ । সাধারনত কাউকে তার কর্মপরিকল্পনা জিজ্ঞাস করুন , দেখবেন  যে সে হয়তো বলবে যে আমি এই এই দিন কাজ করি এবং আমি আমার কাজ কখনই শেষ করতে পারি না । কারন তার কর্মপরিকল্পনা সে কল্পনার মত করে করে । আসলে কর্মপরিকল্পনা করতে হবে বাস্তবতা বুঝে । আপনার কোন কাজ কখন গুরুত্বপূর্ন , কোনটা কখন করলে সুবিধা হবে এই সব পরিকল্পনা করে আগাতে হবে । বুঝতে হবে আপনার কাজের গুরুত্ব ও সেই রকম গুরুত্ব অনুসারেই সাজাতে হবে দিনের কর্মপরিকল্পনা । তা না হলে আপনি বিফল হবেন ও সময়মাফিক কাজ করার আগ্রহ হারিয়ে যাচ্ছেতাই ভাবে কাজ করা শুরু করবেন । যা আপনার লক্ষ্য পৌছাতে বাধা প্রদান করবে । তাই আপনার প্রাথমিক লক্ষ্যই থাকতে হবে যে আপনি যে করেই হোক আপনার যেই কর্মপরিকল্পনা রয়েছে তাতে অটুট থাকবেন ।
এই ধরুন , আজকে চিন্তা করলেন যে আপনি আগামীকাল ঘুম থেকে উঠে পরিস্কার হয়েই বের হবেন এবং সকালে দৌড়াবেন , ব্যায়াম করবেন । কিন্তু দেখা গেলো কি ! আপনি সারা রাত ল্যপটপ নিয়ে পড়েছিলেন , ঘুমালেন দেরী  করে , উঠলেন দেরী করে । তারপর আবার যেতে হলো অফিসে । তাতে কাজের কাজ কিছুই হলো না , আবার সেই একই রকম গেলো দিনটা ।


প্রথমত , আপনি চিন্তা করবেন আপনার সময় নাই , কিছু সময় আছে যা দিয়ে আপনি ঘরের কিছু টুকটাক কাজ করবেন । সুতরাং আপনার দিন আবার আগের মতই যাবে । আপনার শরীরের যত্ন নেয়া হবে না , পরিবারকেও সময় দেয়া হবে না ।

দ্বিতীয়ত , আপনি চিন্তা করলেন যাই হোক , আপনি যেভাবেই হোক দিনের কাজ দিনে শেষ করে ফেলবেন । কাজের সময় সামাজিক মাধ্যমে ঢু মারবেন না । সময় নষ্ট করবেন না । একদম সময়মাফিক চলবেন । বাসায় এসে পরিবারকে সময় দিবেন । রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমাবেন । সকালে ব্যায়াম করবেন । অর্থাৎ গুরুত্বপূর্ণ কাজের ফাকে যদি কিছুটা অবসর সময় পাওয়া যায় তবেই সামাজিক মাধ্যমে সময় দিবেন । কিছুটা সময় গান দেখবেন অথবা আপনার শখের কাজটা করবেন । শরীর , মন সবই ভালো থাকবে যদি সময়মাফিক চলেন । এভাবেই জীবনের সফলতা আসতে পারে ।

সুতরাং আজকের কাজ আজকেই করুন যতটুকু সুযোগ আশা করেছিলেন , যদি তারচেয়েও কম পেয়ে থাকেন ।


সময়মাফিক কাজ কিভাবে করা যায় তার জন্য কিছু পরামর্শ


বর্তমানে সবাই কম বেশি স্মার্ট ফোন ব্যবহার করেন । সেখানে সময়মাফিক চলার জন্য হাজারটা Time management apps পাওয়া যায় । তার কোনটা ব্যাবহার করে প্রতিদিন কি কি কাজ তা মনে করিয়ে দেয়ার জন্য Reminder ব্যবহার করতে পারেন । সেখানে তালিকা করে করে দিনের কি কি কাজ করতে হবে তার Reminder বানিয়ে ফেলতে পারেন । আসলে আমার ক্ষেত্রে এই সময়মাফিক চলার ব্যাপারটা আরো সহজ হয় যদি আপনি আপনার কাজের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেন । তখন এমনিতেই সময়মাফিক চলতে পারবেন ।

তারপরও তিনটি জিনিসের উপর আবার নজর দেই …
১- সকল অর্ধ-সমাপ্ত কাজ একবারে বসেই শেষ করা । অন্য কোন কিছুর দিকে না তাকিয়ে ।

২- গুরুত্বপূর্ণ কাজ সবার আগে আগে শেষ করে ফেলা ।

৩- নিজের সময়সূচি আকড়ে ধরে থাকা এবং তা অনুসরন করার অভ্যাস করা তা যত ছোট কাজই হোক না কেন ।

সোমবার, জানুয়ারী ১৮, ২০১৬

বেথেলহেম - BETHLEHEM

মরিয়ম আর যোসেফ যেদিন বেথেলহেম ঢুকেছিলেন, সেদিন সামনে কোনো বাধা ছিল না। কিন্তু এখন এই শহরে ঢুকতে এক দেয়ালের সামনে দাঁড়াতে হয়। নিরেট কংক্রিট, তিনতলা উঁচু, ধারালো তারে আবৃত দুর্ভেদ্য দেয়াল। এর পাশে দাঁড়লে মনে হয় কোনো বাঁধের কিনারে যেন দাঁড়ানো। অ্যাসল্ট রাইফেল কাঁধে ইসরাইলি সেনারা তোমাকে পরীক্ষা করবে। তোমার কাগজপত্র, যানবাহনসব। কোনো ইসরাইলিকেও এই দেয়াল পেরোতে দেয়ার নিয়ম নেই। বেথেলহেমের লোকদেরও বেরোতে দেয় না অ্যাসল্ট রাইফেল। ইসরাইলের সরকার বলেছে এটা নাকি সন্ত্রাস প্রতিরোধের দেয়াল। বেথেলহেম থেকে জেরুসালেমের দূরত্ব ছয় মাইল। তবু কোন দুর্বোধ্য ভূগোলের মারপ্যাঁচে দুই শহর এখন দুই রাজ্যে। এক শহর থেকে আরেক শহরে পোস্টকার্ড পৌঁছুতে কখনো মাস পেরিয়ে যায়। বেথেলহেম পড়েছে ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে। ১৯৬৭ সালে ছয় দিনের এক যুদ্ধে এই মাটি কেড়ে নিয়েছিল ইসরাইল। অথচ এই শহর ফিলিস্তিনিদের। এখানকার ৩৫ হাজার অধিবাসীর বেশিরভাগই মুসলমান। ১৯০০ সালে এখানকার ৯০ শতাংশ জমিনজুড়ে ছিল খ্রিষ্টানরা। এখন তাদের সংখ্যা মাত্র এক-তৃতীয়াংশ। এই পরিমাণও প্রতিদিন কমছে। খ্রিষ্টানরা চলে যাচ্ছে ইউরোপ কিংবা আমেরিকায়। এই শহর এখন সহিংসতার অন্ধকারে ডুবে আছে। বেথেলহেম আসলে এখন ছমছম আতঙ্কের একটি শহর। ইসরাইলি সেনাদের অনুমতি মিললে স্টিলের একটি স্লাইড-ডোর খুলে যাবে সামনে। সাময়িক এই স্টিলগেট আর ইসরাইলি সেনাদের ফোকর গলে তোমার গাড়ি পেরিয়ে গেলেই আবার বন্ধ হবে গেট। এখন তুমি বেথেলহেমে। জুডাইয়ান মরুভূমির প্রান্তে কতগুলো কাটা-গুল্ম ছাওয়া পাহাড়জুড়ে ছড়িয়ে আছে এই শহর। পুরনো বাড়িগুলো ফ্যাকাসে হলুদ পাথরের। খাড়া-ঘিঞ্জি রাস্তায় ঘেরা। খুব অল্পসংখ্যক ট্যাক্সি এসব পাহাড়ি রাস্তায় চলাফেরা করে। উপরে উঠতে অনবরত হর্ন দিতে হয় ট্যাক্সিগুলোকে। মাঝে মাঝে চোখে পড়বে রেস্তোরা। ওখানে হয়তো মেষের গোশত কাবাব হচ্ছে আর প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে ঘন আরব্য কফিতে চুমুক দিচ্ছে মানুষ। কেমন যেন বোটকা গন্ধ চারদিকে। পাহাড়ে উঠতে চোখে পড়বে সাপের মতো ধূসর আঁকাবাঁকা রেখা। শহরের বর্ধিষ্ণু সীমানার চিহ্ন ওগুলো। আর মাঝে মাঝে বোতলের মতো দাঁড়িয়ে পাহারাদারদের টাওয়ার।

বেথেলহেমের সীমানা বরাবর ফিলিস্তিনিদের তিন-তিনটি উদ্বাস্তু শিবির। বাক্সের মতো এপার্টমেন্টগুলো এলোমেলো গাদাগাদি দাঁড়িয়ে। উদ্বাস্তু শিবিরের ঢোকার রাস্তাগুলোর মোড়ে মোড়ে শহীদদের ছবি আর পোস্টার। কেউ তরুণ, কেউ যুবক, কেউবা এম-১৬ রাইফেল হাতে নির্বিকার দাঁড়িয়ে। তাদের অধিকাংশের জীবন ইসরাইলি বুলেটে স্তব্ধ হয়ে গেছে। কেউ হয়তো ইসরাইলি ট্যাঙ্কের নিচে মাইন-বুকে ঝাঁপিয়ে আত্মাহুতি দিয়েছে। পোস্টারে আরবিতে লেখা ওদের কীর্তিগাথা। দেয়ালের ওপারে ইহুদি বসতি। পাহাড় চূড়া আর উঁচু জায়গাগুলোতে নির্মানসামগ্রী আর ক্রেন দিয়ে ভর্তি। ব্যাঙের ছাতার মতো বাড়ছে এই বসতি। শেষ বিকেলের তীর্যক আলোয় এসব বিল্ডিংগুলো জ্বলে উঠলে বেথেলহেম শহরটিকে মনে হয় যেন আগুন দিয়ে ঘেরা। বেথেলহেমের শীর্ষ পাহাড় চূড়ায় পাথরের তৈরি ম্যাঙ্গার স্কয়ার‘চার্চ অব দ্য নেটিভিটি’। তবে শহরের সবচেয়ে উঁচু আর আকর্ষণীয় স্থাপনাটি একটি মসজিদ। বন্ধ হয়ে যাওয়া দোকানগুলো দেখলে সমৃদ্ধ অতীতের কথা মনে পড়ে। পর্যটন তেমন জমতে পারেনি এখানে। ধর্মীয় পর্যটকরা এখানে ঢোকার অনুমতি পেলে গাইডরা তাদের কোনোমতে ম্যাঙ্গার স্কয়ার দেখিয়ে দ্রুত আবার পাথর দেয়ালের ওপারে জেরুসালেমে ঠেলে দেয়। বেশিরভাগ হোটেলই খালি। রাতে খুব কম পর্যটকই এখানে থাকে। মেয়রের হিসাবে শহরে বেকারের সংখ্যা প্রায় ৫০ শতাংশ। অনেক পরিবারই কোনোমতে খেয়ে-পরে বেঁচে আছে।

চার্চ অব নেটিভিটি যেন অনেকটা লুকিয়ে আছে। দেখতে হয়েছে দুর্গের মতো, কয়েক ফুট পুরু পাথরের দেয়াল আর সামনের দিকটা একেবারেই সাদামাঠা। হয়তো এজন্যই ১৪ শতাব্দী ধরে টিকে আছে। বেথেলহেম সুরম্য বিল্ডিং আর প্রাসাদের জায়গা নয়। এটা ইউরোপ, এশিয়া আর আফ্রিকার ব্যস্ততম সংযোগবিন্দু। প্রতিনিয়ত দখলদারদের আগ্রাসনে ক্ষত বিক্ষত। এখানে পা পড়েছে পার্সিয়ান, বাইজেন্টাইন, মুসলমান শাসক থেকেশুরু করে নিয়ে ক্রুসেডার, মামলুক, অটোম্যান, জর্ডানিয়ান, ব্রিটিশ আর ইসরাইলি সেনাদের। দখলদারদের অশ্ব আর উটের প্রবেশ বন্ধ করতেই হয়তো ধীরে ধীরে সঙ্কুচিত হয়ে গেছে এর প্রবেশদ্বার। এতটাই সঙ্কুচিত হয়েছে যে, শরীর ভাঁজ না করলে এখন আর এখানে ঢোকাই যায় না। চার্চের ভেতরটা ঠাণ্ডা আর অন্ধকার। বাইরের মতোই বৈশিষ্ট্যহীন। চার সারি কলাম পেরিয়ে গেলে মূল বেদি। কোনাা বেঞ্চ নেই। আছে সস্তা কিছু ফোল্ডিং চেয়ার। বেদির নিচে চুনাপাথরের কয়েকটা ধাপ, ছোট্ট একটা গুহা। গ্রাম্য এলাকায় এখনো আছে ২ হাজার বছর আগেও এ ধরনের গুহাতেই গৃহপালিত পশুদের রাখা হতো। এখানে এই উষ্ণ গুহায়, ইহুদি বসতি আক্রান্ত দেয়ালের ভেতরে বন্দী, চারদিকে উদ্বাস্তু শিবিরে থকথকে, দুর্গম মিনারখচিত জঙ্গলে লুকানো প্রাচীন এই চার্চের মেঝের নিচে রাখা আছে একটি রূপালী নক্ষত্র। বলা হয়, এখানেই জন্মেছিলেন হজরত ঈসা (আ:)। বেথেলহেমের মানুষ কেউ কুরআনের কথা বলে, কেউ বাইবেল কিংবা তোরাহ থেকে আওড়ায়। কেউ মাঠ দেখায় তো কেউ দেখায় জলপাই বাগান। কেউ বলে ইতিহাসের কথা, কেউ ভবিষ্যতের স্বপ্ন আঁকে। কেউ হাঁটু গেঁড়ে প্রার্থনা করে, কেউ সেজদা দিয়ে। কেউ পাথর ছোড়ে, কেউ ট্যাঙ্ক চালায়। কেউ হয়তো শরীরে বিস্ফোরক জড়িয়ে প্রস্তুত থাকে। কিন্তু আরো গভীরে গিয়ে এদের ঘৃণা, রাজনীতি আর বিশ্ব কাঁপানো যুদ্ধের পর্দাটা যদি সরানো যায় তাহলে শুনবে এরা সবাই একটা কথাই শুধু বলছে এক টুকরো ভূখণ্ডের কথা বলছে। ধূলি-উড়া, বিশুষ্ক, পাথুরে এক টুকরো শহর বেথেলহেমের কথা বলছে। ইহুদিরাই এখানে প্রথম এসেছিল বললেন রাব্বি মিনাকেম ফ্রোম্যান। ফ্রোম্যান থাকেন ইহুদি বসতি টেকোয়াতে। জায়গাটা মালভূমির মতো। ঝকঝকে কিছু রঙিন পাথরের বাড়ি। বাড়ির ছাদ লাল টাইলসের। অনেক বাড়ির সামনেই গাড়ি দাঁড়ানো। ১ হাজার ৫০০ মানুষের বাস এখানে। টেকোয়ার উত্তর কোনায় দাঁড়ালে পুরো বেথেলহেম নজরে আসে। দিনে পাঁচবার হিসাব কষে আজানের শব্দ এখান থেকেও শোনা যায়। দক্ষিণ দিকে জুডাইয়ান মরু-জঙ্গল। হজরত ঈসা (আ:) এখানেই ৪০ দিন ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাটিয়েছিলেন বলে মনে করা হয়। জুডাইয়ান জংলার পরই নেমে গেছে একটা খাড়া ঢাল। দারুণ অসহিষ্ণু এই ঢাল নামতে নামতে এক বেপরোয়া গভীরে গিয়ে ডুবে গেছে মৃত সাগরে। পৃথিবীর নিম্নতম জায়গা এটাই। ‘এটা শুধু একটা ভূখণ্ড মাত্র নয়’, বলে চলল ফ্রোম্যান। তার দীর্ঘ সাদা দাঁড়ি অপ্রতিরোধ্য স্রোতের মতো উড়ছিল। ‘এটা পবিত্রতম মাটি। তেল, সোনা বা হীরা কিছুই নেই এখানে। উষর মরুভূমি, কিন্তু এটা স্রষ্টার জমিন।’ ৬২ বছরের ফ্রোম্যান ঝরঝর করে তার ১৭ পূর্বপুরুষের নাম বলতে পারেন। তারা সবাই ছিলেন রাব্বি। তার ছেলেও রাব্বি বটে। ফ্রোম্যানের জন্ম বর্তমান ইসরাইলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই এলাকাকে বলা হতো ব্রিটিশ ম্যানডেট ফর প্যালেস্টাইন। বিশ্বযুদ্ধের পর হলোকাস্টের বীভৎসতা দেখে জাতিসঙ্ঘ এই অঞ্চলকে দুই ভাগে ভাগ করার পক্ষে ভোট দেয়। এক ভাগ ইহুদিদের, অন্য ভাগ আরবদের। ইহুদিরা প্রস্তাব লুফে নিলেও আরবরা তা মানতে পারেনি। ১৯৪৮ সালে ইসরাইল স্বাধীনতা ঘোষণার আগেই শুরু হয়ে যায় আরব-ইহুদি যুদ্ধ। ইতিহাসের কলঙ্কজনক এই যুদ্ধে সাড়ে ৭ লাখ ফিলিস্তিনিকে তাদের বাড়িঘর ছাড়তে হয়েছিল। ইসরাইলি আগ্নেয়াস্ত্রই এই অযুত ফিলিস্তিনিকে তাদের মাতৃভূমি ছাড়তে বাধ্য করেছিল। অনেকেই আশ্রয় নিয়েছিল জর্ডান নদীর তীরে, তখনকার মিসর শাসিত গাজায়। পিতৃপুরুষের জমিন থেকে উৎখাত হয়ে সেই প্রথম উদ্বাস্তু হয় ফিলিস্তিনিরা । ১৯৬৭ সালে ৬ দিনের এক বীভৎস যুদ্ধে মিসর, জর্দান, সিরিয়া, ইরাক আর লেবাননের বাহিনীকে পরাজিত করে ইসরাইল। অন্যান্য ভূখণ্ডের সাথে পশ্চিম তীরও দখলে আসে ইসরাইলের। বাইবেলের সূত্রে ইসরাইলিরা পশ্চিম তীরকে বলে জুডাইয়া আর সামারিয়া। দখলের পরপরই সাধের জুডাইয়া আর সামারিয়াতেও বসতি নির্মাণের তোড়জোর শুরু হয় ইহুদিদের। একেবারে শুরুর দিকে যারা এখানে বসত গেড়েছিল, ফ্রোম্যান তাদেরই একজন। আর ১০ জন ইহুদির মতোই তার বিশ্বাস ইহুদিদের জুডাইয়া আর সামারিয়া দখলের কথা ওল্ড টেস্টামেন্টে লেখা আছে। তারাই এখানকার আসল মালিক। ফ্রোম্যান তাই মনে করে স্রষ্টার ইচ্ছাতেই তার এখানে বসবাসের অধিকার আছে। বেথেলহেমের বিস্তৃতি মূল শহর আর আশপাশের গ্রামগুলো নিয়ে। এখানকার ১ লাখ ৮০ হাজার ফিলিস্তিনির মধ্যে ২৫ হাজার খ্রিষ্টান। মানচিত্রে ইহুদি বসতি দেখা যায় ২২টি। ওখানকার জনসংখ্যা ৮০ হাজার হতে চলেছে। সাথে আছে ডজনখানেক ফ্রন্টিয়ার ধরনের অস্থায়ী কোয়ার্টার। মোবাইল-হোম ধরনের এই বসতিগুলোকে বলা হয় আউটপোস্ট।
টেকোয়ার বাড়ির জানালা গলে বেথেলহেমের দিকে তাকান ফ্রোম্যান। বলতে থাকেন কেন এই ‘টুকরো-ভূখণ্ড’ নিয়ে সবার কাড়াকাড়ি। ইহুদিদের বিশ্বাস তাদের মসিহ এখানেই আসবে। বেথেলহেমের ক্ষয়িষ্ণু মাটি আর ধুলাউড়া বাতাসে তারা সেই গন্ধ পান। খ্রিষ্টানরাও আছে যিশুর প্রত্যাবর্তনের অপোক্ষায়। যেখানে জন্মেছিলেন তিনি, প্রত্যাবর্তনও হবে সেখানে এই বিশ্বাসে তারাও আঁকড়ে আছে বেথেলহেম। মুসলমানরা কারো অপেক্ষায় নেই। তাদের আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়। তবে ফিলিস্তিনি মুসলমানদের কাছেও এই জায়গা পবিত্র। কারণ তাদের এক নবী ঈসা (আ:) এখানেই জন্মেছিলেন। কিন্তু ইহুদিদের খোয়াব হলো বেথেলহেম, পশ্চিম তীর থেকে নিয়ে গাজা উপত্যকা আর জেরুসালেমজুড়ে একচ্ছত্র বসতি গড়বে তারাই। জাতিসঙ্ঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন আর ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস ঘোষণা করেছে ইহুদিদের এসব বসতি অবৈধ। দখল করা জমির নাগরিকদের উচ্ছেদ করে সেখানে বসতি গড়া জেনেভা কনভেনশনের পরিষ্কার লঙ্ঘন। শুধু তাই নয়, পশ্চিত তীরে বসত গড়ার জন্য ঋণও দিচ্ছে ইসরাইল। বেথেলহেমেও আছে এরকম বসতি। সবচেয়ে বড়টার নাম হার-হোমা। হার-হোমার ঝকঝকে হাইরাইজ বিল্ডিংগুলো বেথেলহেমের মূল শহরের একেবারে সাথেই। রাস্তার এপাশ-ওপাশ যেন। হার-হোমা এখন জমজমাট শহরতলী। সহজ ঋণের সুবিধা নিয়ে ২ হাজার ইসরাইলি বাসা গেড়েছে এখানে। এদের প্রায় অর্ধেকই নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ দাবি করে। রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীদের অসংখ্য বিলবোর্ডও দাঁড়িয়ে গেছে এখানে। বিজ্ঞাপনের বক্তব্য অনেকটা এরকম ‘দামে সস্তা, জায়গাও চমৎকারকেউ কি আছে জেরুসালেম ছেড়ে এখানে আসার?’ এটা আসলে ইসরাইলি কৌশল। ইসরাইল স্বাধীনতা ঘোষণার পর ১৯৪৯ সালে যে তথাকথিত গ্রিন লাইন টেনে দুই দেশের মধ্যে জায়গা ভাগ হয়েছিল, এর পূর্বদিকে যত অল্প জায়গায় যত বেশি ইসরাইলি বাস করবে, সে জায়গা তত সহজে ইসরাইলের অন্তর্ভুক্ত হবে। ইসরাইলের ভাষায় এই কৌশলের নাম ‘ফ্যাক্টস অন দ্য গ্রাউন্ড’। ফিলিস্তিনিরা অবশ্য হার-হোমাকে ‘জাবাল-আবু-ঘুনেইম’ নামেই ডাকে। আদি এই আরবি নামের অর্থ হলো মেষপালকদের পাহাড়। এটা ছিল বেথেলহেমের শেষ উন্মুক্ত পাহাড়গুলোর একটি। পাইনগাছে ছাওয়া পাহাড়ের পাদদেশে পশু চড়াত রাখালরা। সেই বাইবেলের জন্মকালেও এটা চারণভূমিই ছিল। কিন্তু এই চারণভূমিতেই বিল্ডিং তৈরি শুরু হলো ১৯৯৭ সালে। পাহাড় কেটে বানানো হলো এপার্টমেন্ট। যেসব ফিলিস্তিনি এসব জায়গার মালিক ছিল, তাদের এজন্য এক কানাকড়িও দেয়া হয়নি। ইসরাইলিরা পাহাড়ের যে নাম দিয়েছে, হিব্র“ ভাষায় তার অর্থ ‘দেয়াল ঘেরা পাহাড়’। বসতিটা এমনভাবে সাজানো- দেখে যাতে নিরাপদ মনে হয়। যেন শহরতলীর মরূদ্যান। কিন্তু আসলে তা নয়। জায়গাটা ফিলিস্তিনি শহরের এত কাছে যে, আক্রান্ত হওয়া খুবই সহজ। পাথরের আঘাতে এখানকার কোনো গাড়ির কাচ আস্ত ছিল না এক সময়। এখন কাচের বদলে পাথর প্রতিরোধী প্লাস্টিক লাগানো হয় গাড়িতে। দেয়াল নির্মাণের আগে যখন তখন বুলেট এসে বিঁধত এপার্টমেন্টগুলোর দেয়ালে। ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ হওয়া এই ফিলিস্তিনিরাই কখনো হয়তো কোনো ইহুদি বসতিতে আত্মঘাতী বোমা বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ধরা পড়ে মারাও পড়ে ইসরাইলিদের গুলিতে। গুলি শুধু সেনারাই করে না, বেসামরিক ইহুদিরাও করে।

ছয় সন্তানের মা বেদেইন থাকেন ইফরাতে। বলছিলেন, বয়স্ক লোকেরা জীবনে যত না শেষকৃত্য দেখেছে, তাদের শিশুরা দেখেছে তার চেয়ে বেশি। তার সব সন্তানেরই বন্ধু, প্রতিবেশী, সহপাঠী কেউ না কেউ মারা গেছে। অর্থাডক্স ইহুদি হলেও মুসলমানদের মতো মাথায় স্কার্ফ পরেন বেদেইন। বললেন ‘একবার স্কুলবাসে বোমা হামলায় তিন শিশুর পা উড়ে যায়। মারা যায় দু’জন শিক্ষক। এর পর থেকে তার মেয়ে আর সহপাঠীরা স্কুলবাসে বসে আসনের ভঙ্গিতে। তাদের ধারণা বোমা হামলা হলে তাদের পা হয়তো বেঁচে যাবে।’ এত যে সঙ্ঘাত, তাহলে এই দখলি জমিতে আছেন কেন? জিজ্ঞেস করলেই ত্বরিত জবাব ‘আমরা এই জমিন ভালোবাসি।’ এই দিগন্ত, পাহাড়ি বাতাস, আর ইহুদিদের গুমোট-কঠিন কমিউনিটি এসবই ভালোবাসেন বেদেইনরা। ইহুদিদের অনেকের কোমরেই আগ্নেয়াস্ত্র। নিজের বনে যেন নিজেই বাদশাহ। সিনাগগেও অস্ত্র নিয়ে যায় অনেকে। প্রার্থনার জন্য যখন হাত উঠায় তখন হোলস্টারে হ্যান্ডগান চকচক করে। পরিষ্কার বোঝা যায় নিরাপত্তার জন্য একক স্রষ্টারওপর তাদের আস্থা নেই মোটেই। ঈসা (আ:) এর জন্মেরও হাজার বছর আগের কথা। বেথেলহেমকে বলা হতো ডেভিডের শহর। ইহুদিদের জাতশত্র“ গোলিয়াথকে পাথর মেরে হত্যা করেছিলেন এই ইহুদি নেতা। গোলিয়াথ ছিলেন ফিলিস্তিনি গোত্রের। বর্তমানের ফিলিস্তিন শব্দের আমদানিও ওখান থেকেই। যদিও শব্দগত মিল ছাড়া দুই জাতির মধ্যে রক্তের কোনো সম্পর্ক নেই। ক্ষমতায় কম থাকলেও ইহুদিরাই ছিল তখন সংখ্যাগরিষ্ঠ। প্রথম শতাব্দীতে রোমানদের কাছে পরাজিত হয় ইহুদিদের কিছু দুর্বল আর অকার্যকর শাসক। পরাজিত ইহুদিদের পবিত্র ভূমি থেকে বের করে দেয় রোমানরা। পরের ২ হাজার বছর পৃথিবীর এখানে ওখানে ঘুরেছে তারা। কিন্তু পবিত্র ভূমিতে ফেরার ইচ্ছা তাদের কখনো মরেনি। তত দিনে খ্রিষ্টান ধর্মের ভিত্তি শক্ত হয়েছে। চতুর্থ শতাব্দীতে খ্রিষ্টান ধর্ম রূপ নেয় রোমান সাম্রাজ্যের প্রধান ধর্মে। সেই সাথে বেথেলহেম হয়ে ওঠে খ্রিষ্টানদের পবিত্র জায়গাগুলোর একটিতে। ৩২৬ সালে রোমান সাম্রাজ্যের প্রথম খ্রিষ্টান শাসক কনস্ট্যান্টাইনের মা হেলেনা বেথেলহেম সফর করেন। এর পরপরই সেখানে চার্চ অব দ্য নেটিভিটি নির্মাণ করেন কনস্ট্যান্টাইন। হেলেনার সফরের পর রাজকীয় অর্থবিত্তের পাশাপাশি তীর্থযাত্রীদের যাওয়া-আসাও বেড়ে যায় বেথেলহেমে। শহরের আশপাশে বেশ কিছু গির্জাও তৈরি হয় সে সময়। এরপর আসে মুসলমানরা। ১৭ শতাব্দীর শুরুতে বর্তমান সৌদি আরবের মক্কায় ইসলামের বাণী নিয়ে আসেন মোহাম্মদ (সা:)। তার মৃত্যুর এক শতাব্দীর মধ্যেই গোটা আরবে ছড়িয়ে পড়ে ইসলাম। বহু শতাব্দী ধরে বেথেলহেম ছিল মূলত খ্রিষ্টান শহর যদিও প্রতিনিয়ত মুসলমানদের সংখ্যা সেখানে বাড়ছিল। ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুদের ঢল নামলে মুসলমানদের সংখ্যা আরো বেড়ে যায়। তবু খ্রিষ্টানদের সংখ্যাই বেশি ছিল, অন্তত ১৯৬৭ পর্যন্ত। কিন্তু ইসরাইলের বর্বর বিজয় জটিল করে দিলো এই শহরের হিসাব নিকাশ। একদিকে দখলকৃত পশ্চিম তীরে বসতি গাড়তে শুরু করল ইহুদিরা। অন্য দিকে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে খ্রিষ্টানদের দেশ ছাড়ার মাত্রাও গেল বেড়ে, যার শুরু হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেরকালে। আর মাটি আঁকড়ে ইসরাইলিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলল ফিলিস্তিনি মুসলমানরা। বেথেলহেমের সরল-স্বাভাবিক-শান্তিপূর্ণ যুগের সম্পূর্ণ বিলুপ্তির আগের কাহিনী। ম্যাঙ্গার স্কয়ারের কাছেই যে আল-আমাল রেস্টুরেন্ট, এখানকার বেশিরভাগ খদ্দেরই ছিল ইহুদি। চিকেন-পেস্ট সবজি কিংবা শর্মা- স্যান্ডউইচ খেতে আসত তারা। কিংবা মেষের গোশতভরা গরম রুটি। বেথেলহেমে এমনকি বাজারও করত ইহুদিরা। এ অঞ্চলের সবচেয়ে ভালো সবজি বেথেলহেমেই পাওয়া যায় কিনা। কিন্তু ইসরাইলি আগ্রাসন ফিলিস্তিনিদের অপমান আর মানবিক বিপর্যয়ের মুখে দাঁড় করিয়ে দিলো। ঘৃণিত শত্র“র ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ল আত্মসম্মানে গর্বিত একটি জাতি। ইসরাইলি সামরিক আইনের করুণায় যেন বেঁচে থাকতে হয় ফিলিস্তিনিদের। বিমানবন্দর ব্যবহারের সুযোগ নেই। আগ্রাসী বাহিনীকে করও দিতে বাধ্য তারা। দুই দশক এই অমানবিক অপমান-নির্যাতনের ফল হিসেবে ১৯৮৭ সালে জন্ম নিল ইন্তিফাদা এক অনিবার্য অভ্যুত্থান। এখন ইসরাইলি ট্যাঙ্কের বিপরীতে নুড়ি-পাথর হাতে নির্ভিক দাঁড়িয়ে থাকে ফিলিস্তিনি কিশোর। এ যেন সেই প্রাগৈতিহাসিক ডেভিড আর গোলিয়াথেরই আধুনিক রূপ।

এই ক্যাম্পে কোনো ইহুদি এলে সে মারবেই। হয় পাথরের আঘাতে। নইলে ছুরি বা বন্দুকের গুলিতে। সে যেই হোক না কেন। ইহুদি তো ইহুদিই
ইন্তিফাদা তীব্র হলে আলোচনার টেবিলে বসতে বাধ্য হয় ইসরাইল। তখন ১৯৯৩ সাল। ওসলো চুক্তি স্বার হলো । কিন্তু চুক্তি ঠিক রাখেনি কোনো পই। ফল আরেকটি ইন্তিফাদা। ২০০০ সালের সেই অভ্যুত্থান ছিল আরো তীব্র। ইসরাইলি সেনা শেল বর্ষণ করেছে ফিলিস্তিনি শহরগুলোতে। বেসামরিক ইহুদিরা হামলা করেছে গ্রাম আর খামারগুলোতে। প্রতিরোধে সীমিত সামরিক শক্তি নিয়েই ইসরাইলি সেনা আর ইহুদি বসতিতে বারবার প্রত্যাঘাত হেনেছে ফিলিস্তিনিরা। বাধ্য হয়েই দুই বছর পর দেয়াল নির্মাণ শুরু করে ইসরাইল। এখন ইহুদি বলতে শুধু ইসরাইলি সেনারাই প্রবেশ করে বেথেলহেমে। প্রবেশ করে সুসজ্জিত সামরিক যান নিয়ে, আগ্নেয়াস্ত্র থাকে সবসময়ই উদ্ধত, প্রস্তুত। আল-আমাল রেস্টুরেন্টের মালিক ওমর শাওরিয়া। ৫৩ বছরের এক মুসলমান। মানুষটা ছোটখাটো, গোছানো দাঁড়ি আর চোখজোড়া যেন ভীষণ ভারী। রেস্টুরেন্টের ডেকোরেশনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চোখে পড়বে শহীদের একটা পোস্টার হালকা নীল পোলো শার্ট পরা কোঁকড়া চুলের এক বালক। ‘ওটা ওর স্কুলের পোশাক’, বলল শাওরিয়া ছবিটা তার ছেলের।

বছরখানিক আগে ইসরাইলি সেনারা ম্যাঙ্গার স্কয়ারে ঢুকেছিল এক সন্দেহভাজন মিলিশিয়ার খোঁজে। ডজনখানেক সুসজ্জিত সামরিক জিপ নিয়ে এসেছিল প্রায় এক প্লাটুন সেনা। তখন মাত্র বিকেলের শুরু। ১৩ বছরের মোহাম্মদ শাওরিয়া বাবার রেস্টুরেন্টে এসেছিল টাকা নিতে। চুল কাটাতে হবে। এ দিকে ইসরাইলিদের প্রবেশ খেপিয়ে তুলেছিল ফিলিস্তিনিদের। সেনাবহরে পাথর ছুড়তে শুরু করেছে তখন অনেকে। ফল সঙ্ঘর্ষ আর ইসরাইলি সেনাদের গুলিবর্ষণ। কৌতূহলী মোহাম্মদ চলে গিয়েছিল ম্যাঙ্গার স্কয়ারের কাছে। ছেলেকে আশপাশে না দেখেই আতঙ্কিত হয়ে উঠেছিল ওমর। ‘দৌঁড়ে গেলাম ছেলের খোঁজে। কিন্তু আমি পৌঁছার আগেই ইসরাইলিদের বুলেটের ছোবলে পড়েছিল সে’, বলল সে। শরীরের একপাশে গুলি লেগেছিল মোহাম্মদের। ফুটো হয়ে গিয়েছিল লিভার। হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই রক্তরণে নিভে যায় মোহাম্মদের প্রাণ। পরদিন বেথেলহেমের উপকণ্ঠে গোরস্থানের এক অ্যালমন্ড গাছের ছায়ায় কবর দেয়া হয় মোহাম্মদকে। অনেক মানুষের ভিড় হয়েছিল সেদিন। বিলি করা হয়েছিল মোহাম্মদের ছবিওয়ালা পোস্টার। পরে স্মৃতিস্তম্ভও নির্মাণ করা হয় চার্চ অব দ্য নেটিভিটির কাছে, যেখানে মোহাম্মদ গুলিবিদ্ধ হয়েছিল। কথিত আছে, ২ হাজার বছর আগে রাজা হেরোড যেসব শিশুকে হত্যা করেছিল তাদের হাড়-হাড্ডি এখানেই ভূ-গর্ভস্থ এক শবাগারে গাদা করে রাখা হতো। দুই পই দায়ী করে দুই পকে। ওমর শাওরিয়ার মতো ভুক্তভোগীরা সমালোচনা করে ইসরাইলি সামরিক নীতির। তাদের সশস্ত্র অনুপ্রবেশ আর ত্বরিত গুলিবর্ষণ কৌশলের। ইসরাইলি সেনারা বলে সন্ত্রাসীরা তাদের হত্যার চেষ্টা না করলে তাদের ম্যাঙ্গার স্কয়ারে ঢুকতেই হতো না। যতই দোষারোপ-পাল্টা দোষারোপ হোক, সত্য বড় নির্মম। প্রথম ইন্তিফাদা শুরুর পর এ পর্যন্ত ফিলিস্তিনি মারা গেছে ৫ হাজার ৬০০ ’রও বেশি। ইসরাইলি মরেছে ১ হাজার ২০০। প্রতিদিনই বাড়ছে এই সংখ্যা। মধ্যপন্থীরাও আছে বেথেলহেমে। ইহুদি, মুসলমান আর খ্রিষ্টানদের মধ্যে অনেকেই আছে যারা যূথবদ্ধ শান্তির স্বপ্ন দেখে। কিন্তু বাস্তবতা ভীষণ কঠিন। ফিলিস্তিনিরা ইহুদিদের বাজারে সামান্য একটা পণ্য পর্যন্ত বিক্রি করতে পারে না। একইভাবে ফিলিস্তিনি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ইহুদিবাদের ওপর কোনো লেকচার দেয়ার জো নেই। ফিলিস্তিনিদের সাথে ইসরাইলিদের সাক্ষাৎ এখন শুধু চেকপয়েন্টেই হয়। অধিকাংশ ইসরাইলি সেনাই সেখানে থাকে ভারী বুলেটপ্র“ফ পোশাকে ঢাকা। মুখোশের কাচটা এমনই পুরু যে, চেহারা পর্যন্ত ঘোলাটে দেখায়। হতাশার বিস্ফোরণ দেখা যাবে উদ্বাস্তু শিবিরগুলোতে। ইসরাইল রাষ্ট্রের পত্তনের কালে ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ হয়েছিল যেসব ফিলিস্তিনি, তারাই বংশ পরম্পরায় ভীষণ এক ক্রোধ আর দীর্ঘশ্বাস বুকে চেপে টিকে আছে এসব উদ্বাস্তু শিবিরে। বাড়ি কোথায় জানতে চাইলেই এরা যেসব শহরের নাম বলে, ইসরাইল হয়তো সেসব শহর মানচিত্র থেকেই মুছে ফেলেছে। পুরাণের গল্পের মতো এরা ফেলে আসা মিঠা পানি আর সবুজ দিগন্তের গল্প বলে। কেউ হয়তো মেলে ধরে মরচেধরা চাবির গোছা- ইসরাইলের অপজন্মের আগে যেগুলো দিয়ে ঘরের তালা খুলত তাদের পূর্বপুরুষরা। ‘উদ্বাস্তু শিবিরের প্রতিটি ইট-পাথর পর্যন্ত ইহুদিদের ঘেন্না করে’, বলছিল ২৮ বছরের আদেল ফারাজ। দুহেইশা ক্যাম্পে ছোট্ট একটা দোকান আছে তার। ক্যাম্পটা বেথেলহেমের পাহাড়গুলোর গোড়ায়। ক্যাম্পের আধা বর্গ কিলোমিটার জায়গায় ১০ হাজার লোকের বাস। সরু-চাপা গলিপথগুলো যুদ্ধের চিত্রকর্মে খচিত। ভাঙা কাচের ভেতর দিয়ে শিশুরা হাঁটে। খোলা স্যুয়ারেজ লাইন থেকে ময়লা গড়াচ্ছে হয়তো কোথাও। এই এলাকায় অন্তত দু’জন আত্মঘাতী যোদ্ধার খবর মিলে। এদের একজন ছিল কিশোরী। প্রসাধনী, ল্যাম্প আর সিডি বিক্রি করে ফারাজ। লম্বাটে মুখ, কোঁকড়া চুলে জেল দিতে ভালো লাগে তার। ঘন ভ্রর নিচে জ্বলজ্বলে একজোড়া চোখ। একটা পাইপ আছে তার দোকানে। দিনভর আপেল-গন্ধী তামাক টানে সে।
এ যেন সেই প্রাগৈতিহাসিক ডেভিড আর গোলিয়াথেরই আধুনিক রূপ।
এই ক্যাম্পে কোনো ইহুদি এলে সে মারবেই। হয় পাথরের আঘাতে। নইলে ছুরি বা বন্দুকের গুলিতে। সে যেই হোক না কেন। ইহুদি তো ইহুদিই ‘এই ক্যাম্পে কোনো ইহুদি এলে সে মারবেই। হয় পাথরের আঘাতে। নইলে ছুরি বা বন্দুকের গুলিতে। সে যেই হোক না কেন। ইহুদি তো ইহুদিই,’ বলল ফারাজ। তামাকের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ফারাজ জানাল তার বন্ধু মোহাম্মদ ছিল আত্মঘাতী। ২০০২ সালের মার্চে ১৮ বছর বয়সী মোহাম্মদ দারাঘমেহ জেরুসালেমের এক সিনাগগের কাছে আত্মঘাতী বোমায় নিজেকে উড়িয়ে দেয়। ওই বিস্ফোরণে মারা গিয়েছিল ১১ জন। এসব কথার ফাঁকে সিডি প্লেয়ারে গান চড়িয়ে দিলো ফারাজ। বব মার্লির গান। প্রথম ট্র্যাকটা বেজে উঠল: “ইজ দিস লাভ?” ‘বন্ধুকে নিয়ে গর্ব করি আমি’, বলে চলল ফারাজ। ‘বীরের মতো কাজ করেছে মোহাম্মদ। ইসরাইলই আমাদের আত্মঘাতী হতে বাধ্য করেছে। আমাদের কিছুই দেয়নি তারা। কিছু না থাকলে কিছু হারানোরও ভয় থাকে না।’
আর যাদের হারানোর কিছু আছে, স্ত্রী বা সন্তান আছে, সপ্তাহের অধিকাংশ দিনই খুব ভোরে বেথেলহেমের দেয়ালের পাশে লাইনে দাঁড়াতে হয় তাদের। আর যাদের হারানোর কিছু আছে, স্ত্রী বা সন্তান আছে, সপ্তাহের অধিকাংশ দিনই খুব ভোরে বেথেলহেমের দেয়ালের পাশে লাইনে দাঁড়াতে হয় তাদের। ইসরাইলি এলাকায় কাজ খুঁজতে যায় তারা। লাইনে দাঁড়ানোর জায়গাটা পশু-পাখি রাখার স্টিলের খাঁচার মতো। তারা অপোয় থাকে কখন তাদের তল্লাশি হবে, ধাক্কাধাক্কি হবে, আঙ্গুলের ছাপ আর মেটাল ডিটেক্টরের দেয়াল পেরোনো হবে। কাপড় পর্যন্ত খুলতে হয় অনেককে। এই বাছাই চলে প্রায় ২ ঘণ্টা। চেকপয়েন্ট পেরোনোর ন্যূনতম যোগ্যতা হলো স্ত্রী আর কমপক্ষে এক বা একাধিক সন্তান থাকতে হবে। একমাত্র এরাই দিনশেষে বেথেলহেমে ফিরবে বলে মনে করে ইসরাইলি সেনারা।
শত্র“র ঘর নির্মাণের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা এদের লাইনে দাঁড়াতে হয়

অনেকেই ইহুদি বসতিতে নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করে। শত্র“র ঘর নির্মাণের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা এদের লাইনে দাঁড়াতে হয়। ঘর নির্মাণ হয় সেই জমিতে, যেই জমি এক দিন তাদেরই ছিল। দিন শেষে ৩৫ ডলার মজুরি নিয়ে পাথুরে দেয়াল গলে বেথেলহেম ফিরে আসে এরা। সূর্য ওঠার তখনো ঘণ্টাখানেক বাকি। অনেকের সাথে লাইনে দাঁড়িয়ে ৩৫ বছর বয়সী সুফিয়ান সাবাতিন। কার্বন বাতির তব্ আলোয় অন্যরকম নির্বিকার দেখাচ্ছিল তাকে। হাতে কাগজের ব্যাগে রুটি আর হাম্মাস। এই নির্মাণ কাজ আর ভালো লাগে না তার। এখানে যা পায় তার অর্ধেক মজুরি দিলেও বেথেলহেমের ভেতরে যেকোনো কাজ করতে রাজি সে। কিন্তু বেথেলহেমের ভেতরে কোনো কাজ নেই। সপ্তাহের সাতটি দিনই বিস্বাদ হয়ে গেছে সাবাতিনের কাছে: ‘বিছানা থেকে কাজ আবার কাজ থেকে বিছানা। এটা কোনো জীবনই না।’ ফিলিস্তিনিদের অভিযোগ, সামান্য কিছু ইহুদিদের সুবিধার জন্য দেয়ালে ঘিরে পিষ্ট করা হচ্ছে পুরো একটা জাতিকে। তাদের মতে এই সবকিছুর জন্য ইসরাইলিরাই দায়ী। ১৯৬৭ সালে দুর্লভ পানির সব উৎস আর উর্বর জমি দখল করে ইচ্ছেমতো নতুন সীমানা এঁকেছে ইসরাইল। বেথেলহেম শহরকে গুঁজে দেয়া হয়েছে সাত বর্গমাইলের ছোট্ট এক বাক্সে। তিন দিকে এর দেয়ালের বাধা। দেয়াল প্রতিনিয়ত দীর্ঘ হচ্ছে। কড়া সামরিক পাহারায় দিন-রাত কাজ করছে দৈত্যাকার সব নির্মাণ যন্ত্র। কাজ শেষ হলে দেয়ালের দৈর্ঘ্য হবে ৪৫০ মাইল। সে দেয়াল পশ্চিম তীরের ১৫ মাইল ভেতর দিয়ে গাঁথা। দেয়াল নির্মাণ শেষ হলেই ফিলিস্তিনের ১০ শতাংশ অনায়াসে চলে যাবে ইসরাইলের পেটে। ইসরাইল অবশ্য দাবি করে এ দেয়াল স্থায়ী নয়। দুই পরে শান্তি চুক্তি হলেই দেয়াল ভেঙে দেয়া হবে। ফিরিয়ে দেয়া হবে দখল করা জমি। দেয়ালকে দেয়াল বলতেই রাজি নয় ইসরাইল। তাদের ভাষায় এটা ‘নিরাপত্তা বেষ্টনি’। নমুনা স্বরূপ পশ্চিম তীরের অনেক জায়গায় বিদ্যুতায়িত প্যাঁচানো তারের দেয়াল গড়ে তুলেছে তারা। কিন্তু বেথেলহেম ঘিরে যে দেয়াল, সেটা ভীষণ অন্যরকম। ইসরাইলি কোনো কারাগারেরও এত উঁচু দেয়াল নেই। কংক্রিটের এই দেয়াল কিছুটা হলেও স্বস্তি এনেছে ইসরাইলিদের জীবনে। আগের চেয়ে নিরাপদ মনে করে তারা নিজেদের। কিন্তু ফিলিস্তিনি নেতারা বলছেন, দেয়াল দিয়ে আত্মঘাতী যোদ্ধাদের রোখা যাবে না। এখন হামলা কম হচ্ছে, কারণ হামাসসহ ফিলিস্তিনি সংগঠনগুলো শান্তি আলোচনা শুরুর আশায় প্রতিরোধ বন্ধ রেখেছে। ফিলিস্তিনিদের কথা খুব পরিষ্কার যে মরতে চায়, কোনো কংক্রিটের দেয়াল তাকে রুখতে পারে না। আর ইচ্ছা করলে প্রতি ঘণ্টাতেই জেরুসালেমে আত্মঘাতী যোদ্ধা পাঠাতে পারে তারা। বেথেলহেমের গভর্নর সালাহ আল-তামারি অবশ্য পুরো ব্যাপারটা দেখেন ভিন্ন দৃষ্টিতে। তিনি মনে করেন ইসরাইলিরা দেয়ালে ঘিরে ফিলিস্তিনিদের মানসিকভাবে পরাজিত করতে চায়, যাতে তারা নিজ থেকেই এই ভূখণ্ড ছেড়ে যায়। ‘কিন্তু তা হওয়ার নয়’, বললেন আল-তামারি। তার মতে বরং উল্টোটাই ঘটবে। জনসংখ্যার সাধারণ হিসাবে ইসরাইলিরাই হেরে যাবে এক দিন। ইহুদিদের চেয়ে গড়ে মুসলমানদের সন্তান সংখ্যা বেশি।
ফিলিস্তিনি মায়েদের গর্ভই হলো তাদের পারমাণবিক অস্ত্র

এক ইসরাইলি সেনা বলেছিল, ‘ফিলিস্তিনি মায়েদের গর্ভই হলো তাদের পারমাণবিক অস্ত্র।’ সেই হিসাবে ২০১০ সাল নাগাদ সমান সমান হয়ে যাবে ইসরাইল আর ফিলিস্তিনিদের জনসংখ্যা। তারপরই বাড়তে থাকবে ফিলিস্তিনি পারমাণবিক বোমার সংখ্যা। ‘এখানেই থাকব আমি। আমার সন্তানরাও এখানে থাকবে’, বললেন আল-তামারি। ‘ভবিষ্যতে বিশ্বাস করি আমি। ইসরাইলিদের পতন হবেই। এই দেয়াল ভেঙে পড়বে। হয়তো ১০ বছরে, হয়তো ৫০ বছরে। জানি না কখন। কিন্তু পতন এক দিন হবেই।’ বেথেলহেমের খ্রিষ্টানদেরও আলাদা পরিচয় নেই। ইসরাইলিদের চোখে তারাও ‘ফিলিস্তিনি’। পশ্চিমাদের মতো পোশাক-পার্বণ এখন খ্রিষ্টানদের। অন্য দিকে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগলেও ধর্মীয় বিধিনিষেধ আছে মুসলমানদের। তবু সরকারি বেসরকারি অফিস, হাসপাতাল সবখানে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছে মুসলমান আর খ্রিষ্টানরা। এরপরও বেথেলহেমে খ্রিষ্টানরা যেন দিন দিন বহিরাগত হয়ে যাচ্ছে। গত সাত বছরে প্রায় ৩ হাজার খ্রিষ্টান বেথেলহেম ছেড়ে পশ্চিমে পাড়ি জমিয়েছে। বেথেলহেমের খ্রিষ্টানরাও তিনভাগে ভাগ হয়ে আছে।
চার্চ অব দ্য নেটিভিটির প্রতিটি ইঞ্চি নিয়ে বিতণ্ডা আছে গ্রিক অর্থাডক্স, রোমান ক্যাথলিক আর আর্মেনিয়ান অর্থাডক্স খ্রিষ্টানদের মধ্যে। পর্যটকদের চেয়েও চার্চের প্রহরীদের বেশি সামলাতে হয় এসব যাজকদের পারস্পরিক ঠোকাঠুকি। ক্রিসমাসের দিনণ নিয়েও আছে বিবাদ। এক দল বলে ক্রিসমাস হলো ৬ জানুয়ারি। অন্যরা উৎসব করে ২৪ ডিসেম্বর। আর্মেনিয়ান অর্থাডক্সদের কাছে আবার ১৮ জানুয়ারিই সঠিক দিন। বেথেলহেমে বছরে ক্রিসমাস আসে তাই তিনবার। কিন্তু আপনি ক্রিসমাস পালন করুন বা না করুন, কিংবা ধর্ম আপনার কাছে আদৌ কোনো গুরুত্বের বিষয় হোক বা না হোক, আপনার মনে হবে লোবান আর মোমের গন্ধমাখা চার্চের মেঝের নিচে কিছু একটা যেন আছে। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে প্রতিদিন পর্যটক আসে এখানে। অনেকেই ১৪টি ধাপ গুনে নেমে যায় মাটির গভীরে।
নিজের অজান্তেই হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়ে কেউ নিজের অজান্তেই হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়ে কেউ। কেউ প্রার্থনা করে, গান গায়, কাঁদে, কেউবা নেটিভিটির এই কেন্দ্রবিন্দুতে এসে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। প্রত্যেকদিনই এটা ঘটছে, প্রতিটি দিন। গুহার ঠাণ্ডা অস্বস্তিকর বাতাসে ইতিহাসের গন্ধ ভাসে। বেথেলহেমের সংঘাতের ইতিহাস খুব সহজেই পৃথিবীর লাখো কোটি মানুষকে আক্রান্ত করতে পারে। এখানকার কোনো বিস্ফোরণে বড় ধরনের সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়তে পারে সারা পৃথিবী। বেথেলহেমের মেয়র বলছিলেন তার বিশ্বাসের কথা: ‘এই শহরকে খুব সহজেই পৃথিবীর কেন্দ্র ভাবা যায়। এখানে স্থিতি আসবে না তা হতেই পারে না। পৃথিবীতে শান্তি যদি কখনো আসে, তার শুরুটা হতে হবে এখানেই।’

নীল দুনিয়া

অনেকক্ষণ ধরেই সুযোগ খুজছে রনয় , চাচার চোখ ফাকি দিয়ে কিভাবে বাসা থেকে বের হওয়া যায় । কিন্তু ব্যাপারটা খুবই কঠিন হয়ে দাড়াচ্ছে তার জন্য । এখন তো এক রকম বডি গার্ড ছাড়া বাসা থেকে বেরই হতে পারে না সে । হয় চাচাতো ভাই , নাহলে চাচা বা চাচী নিজে গিয়ে স্কুল , কোচিং এ দিয়ে আসবে , নিয়ে আসবে । এত বড় একটা ছেলে , তার সাথে কাউকে আসতে হয় ব্যাপারটা যখন বন্ধুমহল টের পায় , তা যে কি রকম বিভীষিকাময় ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় তা চাচা-চাচী টাইপ মানুষ গুলোর বুঝার কথা না । বাবা মারা যাওয়ার পর মায়ের আচলের নিচেও তার বেশি দিন থাকা হয়নি । মা তার নিজের স্বার্থের কথা চিন্তা করে উন্নত জীবনের আশায় নিজের জন্য এক সঙ্গী ঠিক করে নিয়েছে । সেখানে তার ঠাই হয়নি ! কিন্তু মা তো !! কত ভালোবাসে সে মা কে , তা তো আর ঐ বড়লোক মানুষটা বুঝবে না । তাও সে মায়ের টানে চুপি চুপি মায়ের কাছে যায় , মায়ের কোলে মাথা রেখে একটু খানি সময় পার করে । আবার ঐ লোকটা বাসায় আসার আগেই চুপি চুপি বের হয়ে চলে আসে । কিন্তু আজ চাচাটা কেমন যেন রেগে আছে । সম্ভবত চাচাতো ভাইটার ভার্সিটিতে কিছু হয়েছে । কিন্তু তাতে রনয়ের কি ! রনয় তার মায়ের কাছে যেতে চায় । কিন্তু যদি তার চাচা টের পায় , তাহলে তার স্কুল কোচিং সব বন্ধ হয়ে যাবে । চার দেয়ালের ভিতর তাকে সারাজীবনের জন্য বন্দী হয়ে থাকতে হবে । রনয় বুকে কোল বালিশটা খুব জোরে চেপে ধরে রেখেছে । মনে হচ্ছে যদি একটা পাথর এনে বুকে চেপে রাখতে পারতো !! চাপা কান্নায় আরো কষ্ট হচ্ছে । কোল বালিশ আর বুকের মাঝে মা-বাবার ছবিসহ ফ্রেমটাও আছে । বুকে খুব ফ্রেমের চাপ লাগছে । আরো জোরে চেপে ধরতে চাইছে । পারলে ভিতরে ঢুকিয়ে ফেলে । ওর দুনিয়ায় ঐ ছবিটাই সম্বল । সব ভালোবাসা, দুঃখ-কষ্ট , হাসি , সুখ ... ওহ ! দুঃখিত ... হাসি সুখ তো ওর না ! এটা তো যাদের কিছু আছে , তাদের জন্য । রনয়ের জন্য এসবই Formalities !!
চাচা দোকানে গিয়েছে , চাচাতো ভাইটা তার রুমে ... নাহ ! চাচীও নেই । এই সুযোগ কে ছাড়ে । তাড়াতাড়ি বের হয়ে গেলো রনয় । রিকশা করে চলে আসলো বেইলী রোডে । এখন বাজে ৪ঃ৪৫ । পাঁচটা বাজলেই ঐ লোকটা অফিস থেকে বের হয়ে রওনা দিবে । তারাতারি মায়ের সাথে দেখা করে আসতে হবে ।
" মা ... মা ... " ঘরে মায়ের কোন সাড়া শব্দ নেই । আস্তে করে দরজাটা খুলে মায়ের বেড রুমে চলে আসলো রনয় । মা ঘুমিয়ে আছে । ফ্লোরে এক কৌটা টেবলেট পারে আছে । রনয়ের কেমন যেন লাগছে । কিছু একটা সন্দেহ হচ্ছে । মায়ের কাছে গিয়ে বসলো । হাতটা ধরলো । হাতটা খুব ঠান্ডা । রনয় পালস চেক করা শুরু করলো । নাহ ... অনেক দেরী হয়ে গেছে । বুক ফাটা কান্না আসছে তার । কিন্তু এমন কান্না সারা জীবন আটকিয়ে রেখে তার অভ্যাস হয়ে গিয়েছে রনয়ের । চোখে পানি আসছে না আর । মায়ের অন্য হাতে একটা কাগজ ছিলো । সেখানে সেই সঙ্গীর উদ্দেশ্যে কিছু লিখা ছিলো । যা ছিলো তার অর্থ ছিলো , রনয়ের মা অর্থ বিত্তের সুখের মাঝেই ছিলো , কিন্তু মনের সুখ বলে তার কিছুই ছিলো না । রনয়ের বাবা মারা যাবার পর রনয় ছাড়া আর কেউই তাকে ভালোবাসেনি । সে রনয়কেও কাছে রাখতে চাইলেও সেই উচ্চবিত্তের লোকটি রনয়কে পছন্দ করেনি । গুরুত্ব দেয়নি তার কোন ধরনের পছন্দ অপছন্দ । তার কাছে অর্থের মূল্য ছিলো , কিন্তু ভালোবাসার না । আর কেউ তাকে ফিরিয়ে নিবে না । তার আর কোন যাওয়ার যায়গাও অবশিষ্ট নেই । তাই রনয়ের মা তার "প্রিয়তম" এর কাছে চলে যাচ্ছে । সে যানে , রনয়ের বাবা তাকে ফিরিয়ে দিবে না । :)
বাসায় ঢুকার পরই দেখে চাচা-চাচী , চাচাতো ভাই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে । সবার চোখেই অগ্নি দৃষ্টি । রনয় চাচার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসির ভাব দেখালো । " আর যাবো না , উনিও বাবার কাছে চলে গেছেন । আর চিন্তা করতে হবে না আপনাদের । "

সুখের ক্রেডিট কার্ড

রাগ করেই ঘর থেকে বেড়িয়ে পড়লাম। এতটাই রেগে ছিলাম যে বাবার জুতোটা পড়েই বেরিয়ে এসেছি।
বাইকই যদি কিনে দিতে পারবেনা, তাহলে ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ার বানাবার সখ কেন.?
হঠাৎ মনে হল পায়ে খুব লাগছে।
জুতোটা খুলে দেখি একটা পিন উঠে আছে।
পা দিয়ে একটু রক্তও বেরিয়েছে। তাও চলতে থাকলাম।
এবার পাটা ভিজে ভিজে লাগল।
দেখি পুরো রাস্তাটায় জল।
পা তুলে দেখি জুতোর নিচটা পুরো নষ্ট হয়ে গেছে।
বাসস্ট্যান্ডে এসে শুনলাম একঘন্টা পর বাস।
অগত্যা বসে রইলাম।
হঠাৎ বাবার মানি ব্যাগটার কথা মনে পড়ল, যেটা বেরোবার সময় সঙ্গে নিয়ে এসেছিলাম।
বাবা এটায় কাউকে হাত দিতে দেয় না।
মাকেও না।
এখন দেখি কত সাইড করেছে।
খুলতেই তিনটে কাগজের টুকরো বেরল।
প্রথমটায় লেখা "ল্যাপটপের জন্য চল্লিশ হাজার লোন"।
কিন্তু আমার তো ল্যাপটপ আছে, পুরনো বটে।
দ্বিতীয়টা একটা ডা: প্রেসক্রিপশন। লেখা "নতুন জুতো
ব্যাবহার করবেন"।
নতুন জুতো।
মা যখনই বাবাকে জুতো কেনার কথা বলত বাবার উত্তর ছিল "আরে এটা এখনও ছ'মাস চলবে"।
তাড়াতাড়ি শেষ কাগজটা খুললাম। "পুরানো স্কুটার
বদলে নতুন বাইক নিন" লেখা শোরুমের কাগজ।
বাবার স্কুটার!!
বুঝতে পেরেই বাড়ির দিকে এক দৌড় লাগালাম।
এখন আর জুতোটা পায়ে লাগছে না।
বাড়ি গিয়ে দেখলাম বাবা নেই।
জানি কোথায়।
একদৌড়ে সেই শোরুমটায়।
দেখলাম স্কুটার নিয়ে বাবা দাঁড়িয়ে। আমি ছুটে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরলাম।
কাঁদতে কাঁদতে বাবার কাঁধটা ভিজিয়ে ফেললাম।
বললাম "বাবা আমার বাইক চাইনা। তুমি তোমার নতুন
জুতো আগে কেন বাবা। আমি ইঞ্জিনিয়ার হব, তবে
তোমার মতো করে।"
"মা" হল এমন একটা ব্যাঙ্ক, যেখানে আমরা আমাদের সব রাগ, অভিমান, কষ্ট জমা রাখতে
পারি।
আর "বাবা" হল এমন একটা ক্রেডিট কার্ড, যেটা দিয়ে আমরা পৃথিবীর সমস্ত সুখ কিনতে পারি। 

শুক্রবার, জানুয়ারী ১৫, ২০১৬

সম্পর্ক

উফফ! সবাই যেভাবে আমাকে ড্যাব ড্যাব চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে! অবশ্য দেখবে নাই বা কেন, দেখতে তো আমাকে সার্কাস পার্টির জোকার বা যাত্রাপালার অভিনেত্রীদের চেয়ে কোনো অংশে কম লাগছে না! ওদের আর কী দোষ, মজা পেলে মজাতো লুটবেই! রাগে আমার গা রি রি করছে। বিরক্ত লাগে একদম। জীবনে কিছুতো নিজের ইচ্ছে মত করতে পারলাম না, সবকিছুতেই শুধু শুনেছি একটিই কথা, 'মা, ওতটুকু করার তো সাধ্যে নেই'! প্রথম প্রথম অনেক কষ্ট পেতাম, কিন্তু পরে আর কিছু বলতামই না, কারণ আমার ওই বাক্যটি শুনতে অসহ্য লাগত। যাই হোক, সেসব কথা বলে আর লাভ নেই, কথা হলো বিয়ে নিয়ে সব মেয়েরই একটা আলাদা স্বপ্ন থাকে। আমার ও ছিল, তবে বেশি কিছু না, চেয়েছিলাম বিয়ের সাজটা পারসোনায় সাজতে। চাওয়াটা কি খুব বেশি ই ছিল? কিন্তু না, সেটা ও পূরণ হলো না, শুধু না, না, আর না। অসহ্য লাগে এখন সবকিছু। কোথাকার কোন সঙের পার্লারে নিয়েছে, সঙ সাজিয়েছে আমায়। অনুষ্ঠানটা যত তাড়াতাড়ি শেষ ততই মঙ্গল। দম আটকে আসছে আমার এখানে .... একবার শ্বশুর বাড়ি যাই, তারপর আর কখনোই এই অভাবের ঘরমুখো হব না। শুনেছি বর নাকি ভালো একটা জব করে, আশা রাখি সেখানে আমার সব ইচ্ছে পূরণ হবে ..…

ঘরে তেমন আসবাব নেই, তবে খুব সুন্দর করে ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে সবকিছু। মৃদু আলো জ্বলায় বাকি জিনিস ঠিক বুঝা যাচ্ছে না। অবশ্য জিনিস কম থাকলে ভালোই, আমার পছন্দ মত সব সাজাতে পারবো। ফুল ছড়ানো খাটে বসে আছি, আর চেষ্টা করছি পুরো ঘরটা বোঝার। একটা প্ল্যান ও মাথায় সাজিয়ে ফেলেছি কিভাবে সাজাবো ঘরটা। উপরে ফ্যান ঘুরছে, সাথে একটা এসি হলে মন্দ হয় না। এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে সে ঘরে ঢুকেছে, খেয়াল করিনি। খেয়াল করলাম তার সম্বোধনে -
- 'আপনাকে কিছু কথা বলার ছিল আমার' .…
(হুম! আদিখ্যেতা দেখিয়ে আপনি ডাকা হচ্ছে! আজকালকার ছেলে হয়ে আসছে ফর্মালিটি দেখাতে!) মনের মধ্যে বেজে চলেছে কথাগুলো, কিন্তু সেটা বাহির পর্যন্ত এগোতে পারলো না। ফর্মালিটি দেখিয়ে বলয়লাম, 'বলুন'
- জানি না কথাটা আপনার কেমন লাগবে, তবে নিজের দিক থেকে ক্লিয়ার থাকা ভালো। দেখুন, আপনি হয়ত অনেক সুখ সাচ্ছন্দ্যে বড় হয়েছেন, কোনো কিছুর অভাব বোধ করেননি, যা চেয়েছেন পেয়েছেন, কিন্তু এখানে হয়্তো আপনার একটু কষ্ট হয়ে যাবে। না মানে, আমি বলছি না যে আপনাকে কষ্ট পেতে হবে, আসলে জবের এমাউন্টটা ভালই, কথা হলো, মানে যা বলতে চাচ্ছিলাম আর কি, এই যে ফ্ল্যাটটা দেখছেন, সেটার পিছনে অনেক খরচ হয়েছে। বাবার পেনশান, জমি বিক্রির টাকা আর অফিসের থেকে নেয়া এডভান্স। অফিস থেকে যা নিয়েছি তাতো পুষিয়ে দিতে হবে, তাই বলছিলাম কি একটু কষ্ট করে যদি ম্যানেজ করে নিতে পারেন..… ঝামেলাটা মিটে গেলেই আর কোনো সমস্যা নেই।
মাথার ভিতরের টেম্পারেচারটা এতক্ষণ ১ ডিগ্রি করে বাড়ছিল, কিন্তু শেষ হওয়ার পর পুরো হাই লেভেলে গেল। ভিতরে ব্রেইনটা সিদ্ধ হওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল। কী বলা উচিত জানি না, শুধু চুপচাপ বসে রইলাম। আশ্চর্য! সব শুধু আমার সাথেই কেন! আমাকেই কেন শুধু ভুক্তভোগী হতে হবে? কিছুই কি নিজের মত করে করতে পারব না, চাইতে পারব না! ধ্যাৎ! বিরক্তি এসে গেলো সবকিছুর উপর .…

সারাদিন আমার তেমন কোনো কাজ নেই। ব্রেকফাস্ট হওয়ার পর সে যায় অফিসে, আর মা-বাবা যায় তাদের ঘরে। আমি মাঝে মাঝে যাই তাদের সাথে গল্প করতে, কিন্তু বেশিক্ষণ থাকি না, কারণ ভালো লাগে না। তারপর দুপুরের রান্না সেরে তো আমি পুরোই বেকার। অলস সময় কাটে আমার। আমাদের পুরো এপার্টমেন্টটা অনেক বড়- ২০ তলা। আজ মনে হলো সবার সাথে একটু পরিচিত হলে ভালো হয়, তাই পাশের ফ্ল্যাট থেকেই শুরু করলাম।
- আরে! পাশের বাসার ভাবী যে! আসেন, আসেন ...
ভালো লাগলো মহিলার ব্যবহার। ড্রইং রুমে ঢুকে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। পছন্দের তারিফ না করে পারলাম না। শুরু থেকে শেষ পরযন্ত আভিজাত্যের ছোঁয়া স্পস্ত। কথায় কথায় জানতে পারলাম তার হাজব্যান্ড ব্যাবসা করে, বাইং হাউস। বুঝতে পারলাম তাদের টাকার অভাব নেই। দুই ছেলে, নিশ্চিন্তের সংসার। হঠাৎ করে মনটা খারাপ হয়ে গেল, চলে এলাম নিজের ঘরে। নিজের ইচ্ছেতাকে বোধ হয় আর বাস্তব করা হবে না।
কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না, একটা গন্ধ নাকে আসায় ঘুমটা ভেঙে গেলো। তাকিয়ে দেখি ঘরে রজনীগন্ধা ফুল রাখা। ফুল আমার এমনিতে পছন্দ হলেও এখন ভালো লাগছে না। বারান্দায় গেলাম মন ভালো করতে, হলো না। আসলে ভালো লাগছে না আর এখানে, তাই আবার চলে গেলাম পাশের ফ্ল্যাটের ভাবীর বাসায়।

এখন আমি সময় পেলেই পাশের ফ্ল্যাটে চলে যাই, ভাবির সাথে কত যে গল্প করি, ভালোই লাগে। আজ ভাবি তার গহনার কালেকশান দেখিয়েছেন। উফফ! কি যে সুন্দর!...... জোস একটা কালেকশান আছে বটে। এখন আর এসব ভেবে দুঃখ করি না, কারণ মনকে মানিয়ে নিয়েছি। যেটা পাব না সেটা নিয়ে ভেবে কি লাভ! থাক না .........।
এভাবেই কাটছিলো সময়, এভাবেই কেটে যেত যদি না সেদিন এমনটি না হতো। সেদিনের পর থেকে আমার কাছে লাইফের মিনিংসটাই পালটে গেলো। জীবনের আসল জিনিসটাই যেন পেয়ে গেলাম।
বই পড়ার অভ্যেস আমার, তাই রাতের খাওয়া শেষে একটা বই পড়ছিলাম। হঠাৎ কানে এলো কান্নার আওয়াজ। উৎস খুঁজতে গিয়ে দেখি শব্দটা পাশের ফ্ল্যাট থেকেই আসছে। সেখানে গিয়ে দেখি ভাবী বারবার শুধু মূর্ছা যাচ্ছে। কারণ অনুসন্ধানে জানতে পারলাম, কোনো এক প্রোগ্রাম থেকে ফেরার পথে ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে আর তাতে তার মহামূল্যবান ডায়মন্ডের নেকলেসটি হারাতে হয়। সেই শোকে তার এই অবস্থা। তার হাজব্যান্ড ও দেখি তাকে দোষারোপ করছে আর টাকার জন্য বিলাপ করছে। আমি তাদের কিছু বলতে পারলাম না, চলে এলাম।
ঝিম মেরে বসে ছিলাম খাটে, ভাবতে পারছিলাম না মানুষ এতটা বুদ্ধিভ্রষ্ট কিভাবে হয়! যেখানে তাদের প্রাণটাই চলে যেতে পারতো সেখানে সামান্য একটা নেকলেসের জন্য তারা ......... নিজের প্রাণের চেয়েও টাকাটাই তাদের কাছে সবচেয়ে বেশি দামি! আরে, নিজের প্রাণটাই যদি না থাকে, তো এসব কার জন্য! না, আর ভাবতে পারছি না এসব। 
খাট থেকে নেমে ড্রেসিং টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলাম। প্রথম ড্রয়ার - না, তেমন কিছু নেই তাতে, কিন্তু অনেক কিছুই আছে, অনেক গুরুত্বপূর্ণ কিছু। হুম, আর তা হলো, মুঠোভরতি ভালোবাসা, যা এতদিন ছিল আমার বোধগম্যের বাইরে। আমার বর আমার জন্যে প্রতিদিন বিভিন্নরকম ফুল আনত আর আমি তা আগ্রাহ্য করতাম। এতদিন ভাবতাম টাকাপয়সাই সব, কিন্তু আজ সেসব মিথ্যে হয়ে গেলো। আসলে টাকাপয়সা অঢেল পরিমাণে না থাকলেও কখনো ভালবাসার অভাব হয় নি, যথেষ্ট পরিমাণ সুখেই ছিলাম, আর এখন থেকে প্রতিদিন ই থাকবো। ভালবাসার সুখ সবার কপালে জুটে না, আর আমি কিনা! 
না, না, এতো বোকা আমি না।

লেখিকাঃ Parinita Rituparna

Emergency Loan - জরুরী ঋণ

Emergency Loan - জরুরী ঋণ: জরুরী মুহূর্তে আপনাকে আর্থিকভাবে সাহায্য করতে প্রস্তুত আছে অনেক প্রতিষ্ঠান। জেনে নিন কিভাবে কাজ করে জরুরী ঋণ প্রদানকারী সংস্থা গুলো। চিন্তা মুক্ত থাকুন জরুরী মুহূর্ত গুলো।

বৃহস্পতিবার, জানুয়ারী ১৪, ২০১৬

Mashrafe - The Captain of banGLADesh

প্রতিটি ম্যাচেই, জয় কিংবা পরাজয়, সুখ কিংবা দুঃখ প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিদ্যমান। মাশরাফি!
.
প্রতিটি ম্যাচ শেষেই প্রতিপক্ষের অধিনায়কের সঙ্গে হাত মেলানোর সময়ে মাথার ক্যাপ বাম হাত দিয়ে খুলে প্রতিপক্ষের অধিনায়ক এবং কখোনো সখনো প্লেয়ার কিংবা কর্মকর্তাকে সম্মান করেন মাশরাফি। টিভি ধারভাষ্যকার তখন মাইক্রোফোন হাতে কমেন্ট্রি বক্সে বলতে থাকে, 'Mashrafe! Thats a Great Ans respect Moment'. সম্মান কাকে বলে সেটা মাশরাফি জানেন, তাইতো সবাইকে সম্মান দেখান তিনি ক্যাপ খুলে ধন্যবাদ জানানো। হয়তো তার এই দৃশ্য দেখে শিখে নেয় অন্যেরা। তাইতো মাশরাফিকে তারা ভালবাসে। অনেকের মতে এটাই হলো প্রতিপক্ষকে মাশরাফির সবচেয়ে সেরা সম্মান প্রদর্শন। রেস্পেক্ট ম্যাশ।

সম্পর্ক ভাঙ্গার ১০১ উপায়

মানিব্যাগটা হাতে নিতেই বুঝতে পারলাম এখান থেকে বেশ কিছু টাকা হাত সাফাই হয়েছে। গুনে দেখি দুইশো টাকা মতো গায়েব। আমার মানিব্যাগ থেকে টাকা গায়েব...