শুক্রবার, জানুয়ারী ১৫, ২০১৬

সম্পর্ক

উফফ! সবাই যেভাবে আমাকে ড্যাব ড্যাব চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে! অবশ্য দেখবে নাই বা কেন, দেখতে তো আমাকে সার্কাস পার্টির জোকার বা যাত্রাপালার অভিনেত্রীদের চেয়ে কোনো অংশে কম লাগছে না! ওদের আর কী দোষ, মজা পেলে মজাতো লুটবেই! রাগে আমার গা রি রি করছে। বিরক্ত লাগে একদম। জীবনে কিছুতো নিজের ইচ্ছে মত করতে পারলাম না, সবকিছুতেই শুধু শুনেছি একটিই কথা, 'মা, ওতটুকু করার তো সাধ্যে নেই'! প্রথম প্রথম অনেক কষ্ট পেতাম, কিন্তু পরে আর কিছু বলতামই না, কারণ আমার ওই বাক্যটি শুনতে অসহ্য লাগত। যাই হোক, সেসব কথা বলে আর লাভ নেই, কথা হলো বিয়ে নিয়ে সব মেয়েরই একটা আলাদা স্বপ্ন থাকে। আমার ও ছিল, তবে বেশি কিছু না, চেয়েছিলাম বিয়ের সাজটা পারসোনায় সাজতে। চাওয়াটা কি খুব বেশি ই ছিল? কিন্তু না, সেটা ও পূরণ হলো না, শুধু না, না, আর না। অসহ্য লাগে এখন সবকিছু। কোথাকার কোন সঙের পার্লারে নিয়েছে, সঙ সাজিয়েছে আমায়। অনুষ্ঠানটা যত তাড়াতাড়ি শেষ ততই মঙ্গল। দম আটকে আসছে আমার এখানে .... একবার শ্বশুর বাড়ি যাই, তারপর আর কখনোই এই অভাবের ঘরমুখো হব না। শুনেছি বর নাকি ভালো একটা জব করে, আশা রাখি সেখানে আমার সব ইচ্ছে পূরণ হবে ..…

ঘরে তেমন আসবাব নেই, তবে খুব সুন্দর করে ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে সবকিছু। মৃদু আলো জ্বলায় বাকি জিনিস ঠিক বুঝা যাচ্ছে না। অবশ্য জিনিস কম থাকলে ভালোই, আমার পছন্দ মত সব সাজাতে পারবো। ফুল ছড়ানো খাটে বসে আছি, আর চেষ্টা করছি পুরো ঘরটা বোঝার। একটা প্ল্যান ও মাথায় সাজিয়ে ফেলেছি কিভাবে সাজাবো ঘরটা। উপরে ফ্যান ঘুরছে, সাথে একটা এসি হলে মন্দ হয় না। এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে সে ঘরে ঢুকেছে, খেয়াল করিনি। খেয়াল করলাম তার সম্বোধনে -
- 'আপনাকে কিছু কথা বলার ছিল আমার' .…
(হুম! আদিখ্যেতা দেখিয়ে আপনি ডাকা হচ্ছে! আজকালকার ছেলে হয়ে আসছে ফর্মালিটি দেখাতে!) মনের মধ্যে বেজে চলেছে কথাগুলো, কিন্তু সেটা বাহির পর্যন্ত এগোতে পারলো না। ফর্মালিটি দেখিয়ে বলয়লাম, 'বলুন'
- জানি না কথাটা আপনার কেমন লাগবে, তবে নিজের দিক থেকে ক্লিয়ার থাকা ভালো। দেখুন, আপনি হয়ত অনেক সুখ সাচ্ছন্দ্যে বড় হয়েছেন, কোনো কিছুর অভাব বোধ করেননি, যা চেয়েছেন পেয়েছেন, কিন্তু এখানে হয়্তো আপনার একটু কষ্ট হয়ে যাবে। না মানে, আমি বলছি না যে আপনাকে কষ্ট পেতে হবে, আসলে জবের এমাউন্টটা ভালই, কথা হলো, মানে যা বলতে চাচ্ছিলাম আর কি, এই যে ফ্ল্যাটটা দেখছেন, সেটার পিছনে অনেক খরচ হয়েছে। বাবার পেনশান, জমি বিক্রির টাকা আর অফিসের থেকে নেয়া এডভান্স। অফিস থেকে যা নিয়েছি তাতো পুষিয়ে দিতে হবে, তাই বলছিলাম কি একটু কষ্ট করে যদি ম্যানেজ করে নিতে পারেন..… ঝামেলাটা মিটে গেলেই আর কোনো সমস্যা নেই।
মাথার ভিতরের টেম্পারেচারটা এতক্ষণ ১ ডিগ্রি করে বাড়ছিল, কিন্তু শেষ হওয়ার পর পুরো হাই লেভেলে গেল। ভিতরে ব্রেইনটা সিদ্ধ হওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল। কী বলা উচিত জানি না, শুধু চুপচাপ বসে রইলাম। আশ্চর্য! সব শুধু আমার সাথেই কেন! আমাকেই কেন শুধু ভুক্তভোগী হতে হবে? কিছুই কি নিজের মত করে করতে পারব না, চাইতে পারব না! ধ্যাৎ! বিরক্তি এসে গেলো সবকিছুর উপর .…

সারাদিন আমার তেমন কোনো কাজ নেই। ব্রেকফাস্ট হওয়ার পর সে যায় অফিসে, আর মা-বাবা যায় তাদের ঘরে। আমি মাঝে মাঝে যাই তাদের সাথে গল্প করতে, কিন্তু বেশিক্ষণ থাকি না, কারণ ভালো লাগে না। তারপর দুপুরের রান্না সেরে তো আমি পুরোই বেকার। অলস সময় কাটে আমার। আমাদের পুরো এপার্টমেন্টটা অনেক বড়- ২০ তলা। আজ মনে হলো সবার সাথে একটু পরিচিত হলে ভালো হয়, তাই পাশের ফ্ল্যাট থেকেই শুরু করলাম।
- আরে! পাশের বাসার ভাবী যে! আসেন, আসেন ...
ভালো লাগলো মহিলার ব্যবহার। ড্রইং রুমে ঢুকে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। পছন্দের তারিফ না করে পারলাম না। শুরু থেকে শেষ পরযন্ত আভিজাত্যের ছোঁয়া স্পস্ত। কথায় কথায় জানতে পারলাম তার হাজব্যান্ড ব্যাবসা করে, বাইং হাউস। বুঝতে পারলাম তাদের টাকার অভাব নেই। দুই ছেলে, নিশ্চিন্তের সংসার। হঠাৎ করে মনটা খারাপ হয়ে গেল, চলে এলাম নিজের ঘরে। নিজের ইচ্ছেতাকে বোধ হয় আর বাস্তব করা হবে না।
কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না, একটা গন্ধ নাকে আসায় ঘুমটা ভেঙে গেলো। তাকিয়ে দেখি ঘরে রজনীগন্ধা ফুল রাখা। ফুল আমার এমনিতে পছন্দ হলেও এখন ভালো লাগছে না। বারান্দায় গেলাম মন ভালো করতে, হলো না। আসলে ভালো লাগছে না আর এখানে, তাই আবার চলে গেলাম পাশের ফ্ল্যাটের ভাবীর বাসায়।

এখন আমি সময় পেলেই পাশের ফ্ল্যাটে চলে যাই, ভাবির সাথে কত যে গল্প করি, ভালোই লাগে। আজ ভাবি তার গহনার কালেকশান দেখিয়েছেন। উফফ! কি যে সুন্দর!...... জোস একটা কালেকশান আছে বটে। এখন আর এসব ভেবে দুঃখ করি না, কারণ মনকে মানিয়ে নিয়েছি। যেটা পাব না সেটা নিয়ে ভেবে কি লাভ! থাক না .........।
এভাবেই কাটছিলো সময়, এভাবেই কেটে যেত যদি না সেদিন এমনটি না হতো। সেদিনের পর থেকে আমার কাছে লাইফের মিনিংসটাই পালটে গেলো। জীবনের আসল জিনিসটাই যেন পেয়ে গেলাম।
বই পড়ার অভ্যেস আমার, তাই রাতের খাওয়া শেষে একটা বই পড়ছিলাম। হঠাৎ কানে এলো কান্নার আওয়াজ। উৎস খুঁজতে গিয়ে দেখি শব্দটা পাশের ফ্ল্যাট থেকেই আসছে। সেখানে গিয়ে দেখি ভাবী বারবার শুধু মূর্ছা যাচ্ছে। কারণ অনুসন্ধানে জানতে পারলাম, কোনো এক প্রোগ্রাম থেকে ফেরার পথে ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে আর তাতে তার মহামূল্যবান ডায়মন্ডের নেকলেসটি হারাতে হয়। সেই শোকে তার এই অবস্থা। তার হাজব্যান্ড ও দেখি তাকে দোষারোপ করছে আর টাকার জন্য বিলাপ করছে। আমি তাদের কিছু বলতে পারলাম না, চলে এলাম।
ঝিম মেরে বসে ছিলাম খাটে, ভাবতে পারছিলাম না মানুষ এতটা বুদ্ধিভ্রষ্ট কিভাবে হয়! যেখানে তাদের প্রাণটাই চলে যেতে পারতো সেখানে সামান্য একটা নেকলেসের জন্য তারা ......... নিজের প্রাণের চেয়েও টাকাটাই তাদের কাছে সবচেয়ে বেশি দামি! আরে, নিজের প্রাণটাই যদি না থাকে, তো এসব কার জন্য! না, আর ভাবতে পারছি না এসব। 
খাট থেকে নেমে ড্রেসিং টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলাম। প্রথম ড্রয়ার - না, তেমন কিছু নেই তাতে, কিন্তু অনেক কিছুই আছে, অনেক গুরুত্বপূর্ণ কিছু। হুম, আর তা হলো, মুঠোভরতি ভালোবাসা, যা এতদিন ছিল আমার বোধগম্যের বাইরে। আমার বর আমার জন্যে প্রতিদিন বিভিন্নরকম ফুল আনত আর আমি তা আগ্রাহ্য করতাম। এতদিন ভাবতাম টাকাপয়সাই সব, কিন্তু আজ সেসব মিথ্যে হয়ে গেলো। আসলে টাকাপয়সা অঢেল পরিমাণে না থাকলেও কখনো ভালবাসার অভাব হয় নি, যথেষ্ট পরিমাণ সুখেই ছিলাম, আর এখন থেকে প্রতিদিন ই থাকবো। ভালবাসার সুখ সবার কপালে জুটে না, আর আমি কিনা! 
না, না, এতো বোকা আমি না।

লেখিকাঃ Parinita Rituparna

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সম্পর্ক ভাঙ্গার ১০১ উপায়

মানিব্যাগটা হাতে নিতেই বুঝতে পারলাম এখান থেকে বেশ কিছু টাকা হাত সাফাই হয়েছে। গুনে দেখি দুইশো টাকা মতো গায়েব। আমার মানিব্যাগ থেকে টাকা গায়েব...